কার্প জাতীয় মাছ বলতে দেশি ও বিদেশি রুই জাতীয় মাছকেই বুঝায়। আমাদের দেশে, দেশি কার্পের মধ্যে কাতলা, রুই, মৃগেল, কালীবাউশ এবং বিদেশি কার্পের মধ্যে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, ব্ল্যাক কার্প, কমন কার্প অন্যতম। মাছচাষী ভাইয়েরা আজকে জানব ঘাসখেকো গ্রাস কার্প মাছ চাষ পদ্ধতি।
সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষ হলো কম খরচে জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করে পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা। এ পদ্ধতিতে কম অথবা বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। অনেকেই এই পদ্ধতিতে এখোনো মাছ চাষ করে থাকেন। তবে, নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ এখন শুরু হয়েছে। যেখানে বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ ছাড়া ও নিয়মিত পানি বদল ও বায়ু সঞ্চালনের আধুনিক ব্যবস্থা করা হয়।
প্রথমে জানব গ্রাস কার্পের খাদ্য: গ্রাস কার্প ঘাসখেকো মাছ। তাই গ্রাস কার্পের খাবার সরবরাহের জন্য পুকুরে চার ফুট লম্বা, চার ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট আবেষ্টনীতে ফিডিং রিং ক্ষুদিপানা-কলাপাতা-সবুজ নরম ঘাস প্রতিদিনি সরবরাহ করতে হবে।
লাঠি পুঁতে ফিডিং রিংটিকে আটকে দিতে হবে যাতে ফিডিং রিংটি একই স্থানে অবস্থান করে। ফিডিং রিংটি সব সময় পরিপূর্ণ রাখতে হবে। কেননা গ্রাস কার্প ও সরপুঁটি ক্ষুদ্রাকৃতির পাকস্থলী বিশিষ্ট। তাই ক্ষুধা পাওয়ার সাথে সাথে যাতে সামনে খাবার পেতে পারে সেজন্যে ফিডিং রিংটি সর্বদা ঘাসে পরিপূর্ণ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পুরনো বা ভাঙা রিং পরিবর্তনেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি গ্রাস কার্পের বিষ্ঠা ৫টি কার্পের খাবারের জোগান দিতে পারে।
সম্পূরক খাদ্য ব্যবস্থাপনা : পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতা ভেদে সম্পূরক খাদ্যের মাত্রা নির্ভর করে। তবে সাধারণত মজুদ পুকুরে প্রতিদিন মাছের ওজনের ৩-৫ শতাংশ হারে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শীতকালে মাছের জৈবিক পরিপাকক্রিয়া কমে যায়, ফলে তাদের খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে যায়। এজন্য শীতকালে মাছের ওজনের শতকরা ১-২ ভাগ হারে খাবার দিলেই চলে।
খাদ্যের সাথে সরিষার খৈল ব্যবহার করা হলে পরিমাণমতো একটি পাত্রে সমপরিমাণ পানির সাথে ১২-১৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর পচা সরিষার খৈলের সাথে পরিমাণমতো অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে আধা শক্ত গোলাকার বলের মতো তৈরি করতে হবে। এ খাদ্য দিনে দুইবার অর্থাৎ সকালে ও বিকালে পুকুরের কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে সরবরাহ করতে হবে।
সম্ভব হলে খাদ্য পাত্রের মধ্যে সরবরাহ করলে ভালো হয়। শুকনো গুঁড়া খাবার সরাসরি পুকুরের পানিতে ছড়িয়ে দিলে খাদ্যের অপচয় হয়। এতে মাছের ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ খাদ্যের পচন ক্রিয়ায় পুকুরের পরিবেশ দূষিত হবে।
সার প্রয়োগ : মজুদ পুকুরে সার প্রয়োগের আগে প্রাকৃতিক খাদ্যের অবস্থা জেনে নেয়া ভালো। কারণ সম্পূরক খাদ্য ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করলে পানি দূষণ হতে পারে। সার প্রয়োগের আগে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের অবস্থা জেনে নিতে হবে। এতে সঠিক মাত্রার সার ব্যবহার করা যাবে এবং পুকুরে পানির পরিবেশও ঠিক রাখা সম্ভব হবে। তিনভাবে প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করা যায়।
সেকি ডিস্ক ব্যবহার করতে হবে। পানির রং দেখে পুকুরের প্রাকৃতিক খাবারের অবস্থা জানার কৌশল এভাবে পানি পরীক্ষার পর প্রাকৃতিক খাদ্য কমে গেলে পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে সার প্রয়োগ করতে হয়। সার একত্রে একটি পাত্রে ৩ গুণ পানির সাথে মিশিয়ে ১২-১৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে ৯-১০টার মধ্যে সার গুলানো পানি পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
মাছের নমুনা সংগ্রহকরণ : পুকুরে মাছের বৃদ্ধি ঘটছে কিনা অথবা রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব পরীক্ষা করা এবং পুকুরে মজুদ মাছের পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য মাসে অন্তত দুইবার জাল টেনে মজুদ মাছের শতকরা ১০ ভাগ ধরে তার গড় ওজন বের করতে হবে।
এ গড় ওজন দ্বারা পুকুরের মজুদ মাছের সংখ্যার সাথে গুণ করে মোট মজুদ মাছের পরিমাণ নির্ণয় করে পরবতী সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। একই সময় মাছের দেহের রোগ বালাই আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। এছাড়া ও জাল টানা হলে পুকুরের তলদেশে জমে থাকা মিথেন, অ্যামনিয়া ক্ষতিকর গ্যাস বের হয়ে যাবে। অন্যদিকে জাল টানার ফলে মাছ ছুটাছুটি করেবে। এতে মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে।
অন্যান্য পরিচর্যা : মাছ চাষের সফলতা অধিকাংশ নির্ভর করে পুকুরে পানির পরিবেশ ঠিক রাখার ওপর। কোনো রকম পচন ক্রিয়া যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তাই যেসব পদার্থ পানিতে পচন ক্রিয়া ঘটাতে পারে তা যাতে পুকুরে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে গাছের পাতা পড়ে অনেক সময় পানির পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। এর প্রতিকারের জন্য পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে ফেলতে হবে।
নালা-নর্দমার বিষাক্ত পানি পুকুরে যাতে কোনোক্রমে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য কোনো উৎস থেকে আসা পানি, জাল বা অন্য কোনো পাত্র পুকুরের পানিতে ধোয়া উচিত নয়। এসবের মাধ্যমে পুকুরে রোগবালাই সংক্রমিত হতে পারে। অনেক সময় বাজার থেকে মাছ এনে রান্না কাজের জন্য পুকুরে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়, এতে অনেক সময় পুকুরে রোগ সংক্রমণ ঘটতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে মাছ বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাদের দৈহিক বৃদ্ধি দ্রুততর হয় না। ফলে নির্দিষ্ট বয়সের পরে পুকুরে প্রতিপালন করার প্রয়োজন নেই। কাজেই পুকুরে বড় মাছ রাখা হলে অধিক লাভ পাওয়া যায় না। তাই বাজারজাতকরণ উপযোগী মাছ ধরে ফেলতে হয়।
এছাড়া পুকুরে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার বেশি মাছ মজুদ রাখা হলে ছোট মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। তাই পুকুর থেকে নিয়মিত বড় মাছ ধরে ছোট মাছকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। বড় মাছ ধরে ফেললে পুকুরে বেশি জায়গা হওয়াতে ছোট মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিঘাপ্রতি কার্প জাতীয় মাছের পুকুরে ধারণক্ষমতা ২২৪ কেজি। কাজেই বিঘাপ্রতি ২২৪ কেজির বেশি মাছ আহরণ করে বিক্রয় করতে হবে।
এরপর মাছকে পুকুরে বেশি দিন না রেখে বছর শেষে পুরাপুরি আহরণ করে পরবর্তী বছরের জন্য পুকুর তৈরি করা ভালো। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পুকুরে যখন পানি কম থাকে তখন মাছ ধরে ফেলতে হবে।
ঘাসখেকো গ্রাস কার্প মাছ চাষ পদ্ধতি সংবাদের লেখাটি লিখেছেন মো. রফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া রহমতপুর আবাসিক এলাকা, চাঁদপুর। লেখাটি কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে নেওয়া হয়েছে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৫মার্চ২০২১