চাকরি ছেড়ে সফল গরুর খামারি নোয়াখালীর ইঞ্জিনিয়ার কামরুল

190

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাস করে অন্য সবার মতো চাকরিতে ঢুকেছিলেন মো. কামরুল ইসলাম ইমরান। সকাল সন্ধ্যা অফিস করতে করতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে যান তিনি। মাস শেষে যে বেতন পেতেন তাতে নিজের খরচ জোগাতেই কষ্ট হত তার। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবার জন্য পাঠাতে পারতেন না হাত খরচের টাকা। শেষে ফিরে আসেন বাড়িতে। যুক্ত হন বড় ভাই নজরুল ইসলামের সঙ্গে খামারে। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তার।

২০২০ সালেই ১০০ গরু মোটাতাজাকরণ করেই পেলেন ব্যাপক সাড়া। শুরু হলো ভাগ্য পরিবর্তনের ছোঁয়া। এখন প্রতি বছর দেড় শতাধিক গরু বিক্রি করেন তিনি। সেই খামার থেকে এবার কোরবানির ঈদে ১৭৫ গরু বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন তিনি। যার বাজার মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করা উদ্যোক্তা মো. কামরুল ইসলাম ইমরান নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চর হাজারী ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের হাজীরহাট গ্রামের হাজী আলী আহমদ পাটওয়ারী বাড়ির মো. রফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি এখন নোয়াখালীর বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাচ্ছেন। তার সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন নতুন খামারিরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ৩ একর জমির ওপর নির্মিত কেএন এগ্রোর প্রবেশ পথের বাম পাশে রয়েছে দুটি টিনের শেড এবং ডান পাশে রয়েছে একটি টিনের শেড। শেডের ভেতরে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চা। খামারের ভেতর-বাইরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মশা-মাছি আর পোকামাকড় প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা রয়েছে।

কামরুল ইসলাম ইমরান বলেন, খামারটা আমার বড় ভাই নজরুল ইসলাম ২০১৫ সাল থেকে শুরু করেন। তারপর থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। ২০২০ সালে করোনার মধ্যেই ১০০ গরু মোটাতাজাকরণ করে আলহামদুলিল্লাহ ভালো সাড়া পেয়েছি। এবছর ১৫০ টির বেশি কোরবানির গরু রয়েছে। আমার মাধ্যমে দশজন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

কামরুল ইসলাম ইমরান আরও বলেন, বাংলাদেশ কোরবানির পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাইরে থেকে গরু আনার প্রয়োজন হয় না। এতে করে নতুন নতুন খামারি আসছে। একটা সময় শিল্প বিপ্লব হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারের সহযোগিতায় আমি মনে করি শিল্প বিপ্লব ঘটবে কৃষি খামারে। আগামী বছর ২০০ গরু মোটাতাজাকরণ করার ইচ্ছা আছে।

তরুণ ও বেকারদের উদ্দেশ্যে কামরুল ইসলাম ইমরান বলেন, উদ্যোক্তা হওয়ার বিকল্প নাই। প্রয়োজনে চা দোকান করেন। একদিন এ চা দোকান আপনাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। চেষ্টা করলে সফলতা আসবেই। উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। তবে আমি আধুনিক খামার করে দেখিয়ে দিতে চাই, দেশে শ্রম দিলে বিদেশের থেকে বেশি আয় করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, খামারে বর্তমানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করে। আমার স্বপ্ন আছে শতাধিক শ্রমিক এই খামারে কাজ করবে। এতে করে শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমরা সবার আগে ক্রেতার সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করি। সতেজ হৃষ্টপুষ্ট গরুতে মানুষের আগ্রহ বেশি। ক্রেতা খুশি হলে আমাদের প্রচার এমনিইতেই হবে। কেননা আমরা দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ করছি।

খামারে গরু কিনতে আসা মো. আবদুল আজিজ বলেন, খামারটির শুরু থেকেই আমরা গরু ক্রয় করি। দিন দিন খামারের আয়তন ও মোটাতাজাকরণ গরুর সংখ্যা বাড়ছে। খামারের সফলতা দেখে আমাদেরও ভালো লাগে। এখানে দামও সন্তোষজনক। গরুগুলো দেখতেও সুন্দর।

কামরুল ইসলামের বাবা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার দুই ছেলে খামারে যুক্ত। বড় ছেলে নজরুল ইসলাম প্রবাসে যেতে ব্যর্থ হয়ে খামারে যুক্ত হয়। তাদের মা মারা যাওয়ার পর আমি তাদের মায়ের অভাব বুঝতে দেইনি। খামারটি করার জন্য জমি বিক্রি করেছি। আমি বাবা হিসেবে তাদের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি।

চরহাজারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন সোহাগ বলেন, খামারটিকে তিল তিল করে বেড়ে উঠতে দেখেছি। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ তারা দুই ভাই সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। বড় বিদেশে না যেতে পারলেও এবং ছোটভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরির পিছনে না ছুটে খামারের মাধ্যমে ভালো অবস্থানে আছেন। তারা এখন অনেক বেকার যুবকের অনুপ্রেরণা।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. তাসলীমা ফেরদৌসী বলেন, কোম্পানীগঞ্জের অন্যতম বড় খামার হলো কেএন এগ্রো। ওই খামারের সব গরু আমাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে। নিয়মিত টিকা দেওয়া হচ্ছে। খামারি দুই ভাই দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে সব সময় তাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হয়।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কাজী রফিকুজ্জামান বলেন, মানুষের ভাগ্য তার কর্মের মধ্যে রয়েছে। আর পরিশ্রম ছাড়া সফলতা আসে না। কঠোর পরিশ্রম ও ধৈর্য থাকলে জীবনে সফলতা আসে। অতি সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে নোয়াখালীতে প্রচুর সংখ্যক শিক্ষিত যুবক, প্রবাসী, শিল্পপতি মানুষজন খামারে যুক্ত হচ্ছেন। এতে করে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।