চামড়ার ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

70

প্রতি বছরের মতো এবারো পশু কোরবানির পর পাড়া-মহল্লা থেকে গরু ও খাসির চামড়া কেনেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। গতবারের চেয়ে এবার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৭ টাকা বাড়ানো হলেও কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

ঢাকায় প্রতি পিস গরুর চামড়ার দাম ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও রংপুরে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। সরকার নির্ধারিত লবণযুক্ত চামড়ার দামের অর্ধেক দামেও চামড়া বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

গত কয়েক বছরের মতো এবারও রংপুরে কোরবানির পশুর চামড়া ‘সস্তা দামে’ বেচা-কেনা হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য দাম পাননি কেউ। হাতেগোনা কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সামান্য লাভের মুখ দেখলেও কোরবানির চামড়ায় মোটা অংকটাই গিলতে গা করে আছেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা।

প্রতিবছর এ রকম সিন্ডিকেটের ফাঁদে রংপুরে একদিকে কমছে কোরবানির পশুর চামড়ার আমদানি। অন্যদিকে ন্যায্য দাম না পেয়ে চামড়া মাটিচাপা দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

সচেতন মহল বলেছে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামাতে না পারলে গরীব-দুঃখীরা তাদের হক বঞ্চিত হবেন। তেমনি কোরবানির পশুর চামড়া মাটিচাপা দেওয়া রীতিতে পরিণত হবে। সিন্ডিকেট বন্ধ করে চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও ঋণ সুবিধার আওতায় আনতে হবে।

এদিকে সাধারণ মানুষ এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চামড়ার জন্য প্রসিদ্ধ রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর টার্মিনাল রোডের চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ীরাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে এবারও সস্তায় চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গরুর চামড়ায় দাম মিললেও ছাগলের চামড়া ফ্রি-তে দিতে হয়েছে। চামড়ার দাম কম দিতে নানা অজুহাতের ফাঁদগল্প শুনতে হয়েছে তাদের।

নগরীর বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়। মৌসুমি চামড়া বিক্রেতারা জানিয়েছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া কিনে আনার পর আড়তদারদের কাছে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যায়নি। এতে করে হতাশ তারা।

ইকবাল সুমন নামের একজন তার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করেছেন মাত্র ৪০০ টাকায়। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, চামড়া বেচতে এসে দাম শুনে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এক লক্ষ টাকা দিয়ে গরু কিনে, সেই গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয় পানির দামে। সরকারের বেধে দেয়া দামের কোন প্রভাব পড়েছি। বরং বড় বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের ফাঁদের প্রভাব পুরো চামড়াপট্টি জুড়ে। উপায় না থাকায় কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এতে করে আমার ক্ষতি না হলেও সাধারণ গরীব-মিসকিনের তো ঠিকই ক্ষতি হচ্ছে। কারণ কোরবানির পশুর চামড়ার টাকায় তো তাদের হক রয়েছে।

তবে চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের দাবি, সিন্ডিকেট রংপুরের মতো মফস্বলে পর্যায়ে হয়নি, এটি ঢাকায় হয়ে থাকে। মূলত পুঁজি সংকটসহ লবণের দাম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তারা চামড়া কিনতে পারেননি। বড় ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে লবণের দাম বেশি। এর ওপর শ্রমিকের মজুরির কারণে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

রংপুর নগরীর হাজিরহাট থেকে ১৫০ পিস চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান জানান, প্রতিবর্গফুট মাঝারি গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে ৮০০ এবং বড় গরুর চামড়া এক হাজার থেকে বারোশ দাম হওয়ার কথা। তিনি ওই হিসাবে গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছেন। গাড়ি ভাড়া আনুষঙ্গিক খরচসহ সাড়ে ৬০০ টাকা পড়েছে প্রতি পিস চামড়া কিনতে। কিন্তু আড়তদাররা ৫০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনতে রাজি না হওয়ায়তাকে মোটা অংকের লোকসান মেনে নিতে হয়েছে।

একই কথা জানিয়েছেন নগরীর সিও বাজার এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী। তিনিও গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনে এনে সস্তা দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

ঈদের দিন সকাল থেকে পাড়া মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ৩০টি গরুর ও ৫০টি খাসির চামড়া কেনেন সোহেল রানা। নগরীর স্টেশন রোড এলাকায় মৌসুমী এই ব্যবসায়ী জানান, এবার তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরুর চামড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা মূল্যে কিনেছেন। আর ছাগলের চামড়া নেন ৫-২০ টাকা করে। সন্ধ্যায় সেগুলো স্থানীয় চামড়াপট্টিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছেন।

তবে গরুর চামড়া দুই ক্যাটাগরিতে দুই রকম দামে ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে তাকে লোকসান গুনতে হয় চার হাজার টাকা। আর ছাগলের চামড়ার পুরো অর্থটাই তার গচ্ছা গেছে। সিন্ডিকেটের কারণে তিনি ন্যায্য দাম পাননি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফজাল হোসেন বলেন, সিন্ডিকেট করে কি লাভ? এমনিতেই চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণের বিকল্প কোনো উপায় নেই। এখন আমদানিও কম। লবণের দাম তো বেড়েই চলেছে। এত কিছুর মাঝেও ট্যানারি মালিকেরা সরকারের কাছ থেকে ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে ঋণ সুবিধার বাইরে রয়েছি। আমাদের ঋণ দেওয়া হয় না। অথচ বড় বড় ট্যানারি মালিকেরা চামড়া ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে তা অন্যখাতে বিনিয়োগ করছে।

তিনি আরও বলেন, চামড়া কিনে কোথায় বিক্রি করা হবে, এ নিয়েই চিন্তিত বড় ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের প্রায় দুই শতাধিক ট্যানারির মধ্যে হাতেগনা কয়েকটি ট্যানারি চালু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের বোঝা ভারী করতে চাইছেন না। আর যারা কিনছেন তারা তো লোকসান এড়ানোর চেষ্টা করবেন এটাই স্বাভাবিক।