চিংড়ির সাথে কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষে করণীয়

1065

1480525821_p-11

চিংড়ির সাথে কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষে করণীয় সম্পর্কে আমদের অনেকেরই জানা নেই। আমাদের দেশে মাছ চাষ একটি লাভজনক পেশা। মাছ চাষ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। একটু কৌশল অবলম্বন করলেই মাছ চাষে অধিক লাভবান হওয়া যায়। আসুন জেনে নেই চিংড়ির সাথে অন্যান্য মাছের মিশ্র চাষে করণীয় সম্পর্কে-

চিংড়ির সাথে কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষে করণীয়ঃ
চিংড়ির সাথে কিছু কার্প জাতীয় মাছ যেমন- সিলভার কার্প, কাতলা বা বিগহেড জাতীয় মাছ ছাড়লে এরা প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং এরা চিংড়ির সম্পূরক খাবারে ভাগ বসায় না। এরা এসব প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে চিংড়িকে বসবাসের উপযোগী করে তুলে। তাছাড়া আমরা জানি চিংড়ি পানির নীচের অংশে থাকে এবং সিলভার কার্প, বিগহেড ও কাতলা মাছ পানির উপরে অংশে থাকে তাই চিংড়ির সাথে খাদ্য, আশ্রয় ইত্যাদির কোন প্রতিযোগিতা হয় না।

চিংড়ির সাথে কার্প জাতীয় মাছ চাষের হিসাবঃ

নিম্নে প্রতি শতাংশ জলায়তনে চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছের মজুদ ঘনত্ব বর্ণিত হলো-

১। গলদা জুভেনাইল (ছাটি) ৫০ থেকে ৬০টি।

২। সিলভার, বিগহেড, কাতলা ১০ থেকে ১২টি চিংড়ির সাথে এই মাছগুলো ছাড়া অন্যান্য মাছ দেয়া যাবে না। কারণ সেগুলো চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর।

চুন প্রয়োগঃ

১। চুন ব্যবহার মাটি ও পানির তির রোগজীবানু ধ্বংস হয়।

২। চুন প্রয়োগে (চুনে ক্যালসিয়াম থাকে) মাছ ও চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

৩। চুন নিয়মিত ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।

৪। চুন প্রয়োগে পানির ঘোলাটে ভাব দূর হয়ে পানির ভিতরে সূর্যের আলো প্রবেশে সহযোগিতা করে ও প্রকৃতিক খাদ্য তৈরীর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

৫। চুন সারের কার্যকারিতাকে বৃদ্ধি করে।

৬। পানিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া পানি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করায় মাছের অক্সিজেনের অভাব হয়। চুন প্রয়োগ করলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাকটেরিয়াগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে ফলে তাদের অক্সিজেন ব্যবহার কমে যায়।

৭। চুন প্রয়োগ মূলত নির্ভর করে জমির মাটির গুনাগুনের উপর। জমি তৈরীর সময় পাথুরে চুন শতাংশে ১ কেজি হারে ব্যবহার করা উত্তম।

৮। শুকনা জমির জন্য- জমিতে যখন পানি থাকে না অর্থাৎ শুকনা জমিতে পাথুরে চুন গুড়া করে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। উক্ত চুন শুকনো ঘেরের চাতাল ও পাড়ের মাঝের খালে ও ঢালে ছিটিয়ে দিতে হবে। পানি থাকা অবস্থায় – চাড়ি বা মাটির গর্তে পরিমানমত চুন ৮-১০ ঘন্টা পূর্বে ভিজিয়ে গুলিয়ে নিতে হবে। উক্ত চুন ঘেরের পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।

সার প্রয়োগঃ

চুন প্রয়োগের অন্তত ৫-৭ দিন পর জমিতে তলার প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য জৈব সার বা কম্পোষ্ট সার বা সবুজ সার বা প্রয়োজনে অজৈব সার ব্যবহার করা যেতে পারে। জৈব সার হিসেবে হাঁস-মুরগীর বিষ্টা, পানিতে সরাসরি না দিয়ে অন্ততঃ ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে তারপর প্রয়োগ করা উত্তম। তবে শুকনা জমিতে সরাসরি প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়।

জমি তৈরীর সময়ে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করা যেতে পারেঃ চুন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর শুকনো পুকুরে প্রয়োজনীয় জৈব সার সমান ভাবে মাটিতে ছিটিয়ে লাঙ্গল বা আঁচড়ার সাহায্যে মিশিয়ে দিতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে জৈব সার একত্রে কোন পাত্রে ভালো ভাবে মিশিয়ে রৌদ্রজ্জ্বল দিনে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।

গোবর -৩-৫ কেজি হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠাঃ ১০-১২ কেজি । অবস্থা ভেদে এর পরিবর্তন করতে হতে পারে।

পোণা ছাড়ার উপযোগ্যতা যাচাইঃ

সার প্রয়োগের সময় পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী হয়। পানিতে আনুবিণীক ও দৃশ্যমান বিভিন্ন প্রকার শেওলা ও প্রণী কনাই হলো প্রকৃতিক খাদ্য। প্রাকৃতিক খাদ্যে চিংড়ির স্বাস্থ্য বৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুকুরের পানির রং দেখেও পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যর উপস্থিতি বুঝা যায়।

প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরীর জন্য আলো, তাপ, পুষ্টি পদার্থ ও অনুকুল পরিবেশের প্রােজন হয়। পরিবেশের তারতম্যের জন্য এই প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদনেও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। প্রাকৃতিক খাদ্যের সঠিক মাত্রা নিূপণ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। সার প্রয়োগের ৫-৭ দিনের মধ্যে পানিতে খাবার তৈরী হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে। পানির রঙ হালকা সবুজ, লালচে ও বাদামী সবুজ হলে বুঝতে হবে খাদ্য তৈরী হয়েছে।

তাছাড়া প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে-

১। সেকী ডিস্ক ব্যবহার করে ২। স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস ব্যবহার করে

হাত দিয়ে সেকী ডিস্ক পদ্ধতিঃ সেকী ডিস্ক পানিতে ডুবানেরা পর- লাল সুতা পর্যন্ত – বেশী খাদ্য – সার দিতে হবে না, পোণা ছাড়া যাবে না সবুজ সুতা পর্যন্ত – ভালো খাদ্য – পোণা ছাড়া যাবে, নিমিত সার দিতে হবে সাদা সুতা পর্যন্ত – খাদ্য নেই – সারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে।

হাতের তালু পদ্ধতিঃ সূর্যের আলোয় আলোকিত দিনের ১০-১১ টায় হাতের কনুই পর্যন্ত পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে হাতের তালু / পাতা যদি দেখা না যায় তবে বুঝতে হবে পরিমিত প্রাকৃতিক খাদ্য নেই এবং নিয়মিত সার দিতে হবে। অর্থ্যৎ হাতের তালু না দেখা গেলে বুঝতে হবে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে।

গলদা জুভেনাইল পুকুরে ছাড়ার পূর্বে নার্সারী পুকুরে রেনু লালন-পালন রেণু মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা-

মজুদ ঘনত্বঃ

প্রতি শতাংশে ৫০০-৬০০ টি গলদা রেণু মজুদ করা যেতে পারে। যদি নার্সারীতে ১৫-২০ দিন রেণু লালনের পরিকল্পনা থাকে সে েেত্র প্রতি শতাংশে ১০০০-২০০০ রেণু মজুদ করা যেতে পারে।

রেণু ছাড়ার সময়ঃ

গলদা চিংড়ির পোনা অবশ্যই সন্ধ্যার পর মজুদ করতে হবে। তবে রাত ৮/৯টার মধ্যে মজুদ করা সবচেয়ে ভালো কারন দিনের বেলায় পানির তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় ফলে রেণু তার শরীরে তা অভ্যস্ত করাতে পারে না। ফলে রেণু মারা যায়। কিন্তু রাত্রে পানির তাপমাত্রা খুব ধীর গতিতে কমতে থাকে। যা রেণুর জন্য তেমন অসুবিধা হয় না। তাই রেণু রাত্রেই ছাড়া উত্তম।

রাতে রেণু ছাড়ার মাধ্যমে ভালো ফল পাওয়াা যায় যা কৃষকের মাঠে ১০০ ভাগ পরীতি। রেণুকে অবশ্যই পুকুরের পানির সাথে অভ্যস্ত করে ছাড়তে হবে। পাতিল / ব্যাগের পানির তাপমাত্রা ঐ পুকুরের পানির তাপমাত্রার সমতায় না আসা পর্যন্ত অবশ্যই অপো করতে হবে। পাত্রের পানি আস্তে আস্তে পরিবর্তন করে পোণাসহ পাত্রটি কাত করলে রেণু স্বেচ্ছায় পানিতে বেরিয়ে যাবে।

এই প্রক্রিয়া ২০-৩০ মিনিট পর্যন্ত চলতে পারে। রেণু পানিতে ছাড়ার েেত্র কোনভাবেই তাড়াহুড়া করবেন না, পর্যাপ্ত তাপমাত্রা সঙ্গে রেণুকে খাপ খাওয়াতে হবে। কারণ রেণু বহন পাত্রে ও নার্সারী পুকুরর পানির তাপমাত্রার সমান্য পার্থক্যই রেণুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই ছাড়ার সময় রেণু খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।

চিংড়ির আশ্রয়স্থল স্থাপনঃ

চিংড়ির নার্সারীতে আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করতে হবে। রেণু বাঁচার হার অনেকাংশে নির্ভর করে নার্সারীতে স্থাপিত আশ্রয়স্থলের উপর। চিংড়ির বৃদ্ধি খোলস বদলানোর মাধ্যমে হয়ে থাকে। খোলস বদলানোর সময় চিংড়ি দুর্বল থাকে। চিংড়ির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এরা স্বজাতিভোজী। সব চিংড়ি একসাথে খোলস বদলায় না।

তাই এ সময় সবল চিংড়ি অর্থাৎ যেগুলো খোলস বদলায় না সেগুলো দুর্বল গুলোকে খেয়ে ফেলে। কাজেই এসময় দুর্বল চিংড়ির জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল প্রয়োজন হয়। তাই পোণা মজুদের পূর্বে পুকুরে চিংড়ির জন্য আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আশ্রয়স্থল হিসেবে শুকনো বাঁশের শাখা-প্রশাখাসহ (ঝংলা) উপরের অংশ খুবই উপযোগী।

আশ্রয় ছাউনী তৈরীঃ

নার্সারী পুকুরের পানি যাতে অতিরিক্ত গরম হয়ে না যায় কিংবা পানি গরম হয়ে গেলে চিংড়ির রেণু ঠান্ডা জায়গায় আশ্রয় নিতে পারে সেজন্য নার্সারী পুকুরের উপরে অর্ধেকাংশে নারিকেল পাতা দিয়ে মাচার আকারে ছাউনী দিতে হবে।

রেণু বেঁচে থাকা পর্যবেক্ষণঃ

রেণু বা পিএল ছাড়ার পরদিন পুকুরে গামছা বা মশারীর জালের খন্ড দিয়ে পুকুরের এক কোণায় টেনে রেণুর অবস্থা দেখতে হবে, যদি প্রতি টানে ৪/৫ করে রেণু আসে তবে বুঝতে হবে বাঁচার হার খুবই ভালো। কৃষক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, নার্সরী পুকুরে রেণু ছাড়ার পর দুইদিন টিকে গেলে পরবর্তীতে আর তেমন ঝুঁকি থাকে না।

স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণঃ

রেণূর স্বাস্থ্য ভালো আছে কিনা এবং স্বাস্থ্য বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা পরীা করতে হবে। পুকুরে গামছা বা মশারীর জালের খন্ড দিয়ে টেনে রেণুর অবস্থা দেখতে হবে, যদি রেনু গুলো খুব দ্রুত নড়াচড়া করে তবে বুঝতে হবেরেণুর স্বাস্থ্য ভাল আছে। এভাবে ৩০ থেকে ৪৫ দিনে নার্সারীতে রেণু লালন পালনের পর বড় পুকুরে মজুদ করতে হবে।

গলদা রেণু চাষের গুরুত্বপূর্ণঃ

সন্ধ্যার পর রেণু মজুদ করা। নার্সারীতে ঝোঁপঝাড় (ঝিংলা) দেয়া। নিয়মিত সন্ধ্যার পর খাবার দেয়া। রেণু বেঁচে থাকা পর্যবেণ করা। নার্সরী পুকুরের যে কোন একপাশে ছায়ার ব্যবস্থা করা। ৭. নিয়মিত (মাসে দু’বার) চিংড়ির নমুনা পর্যবেণ। – মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা-

সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগঃ

গলদা চিংড়ি প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর নির্ভর করে না। তাই তাকে প্রতিদিন সম্পুরক খাদ্য দিতে হবে। পোণা মজুদের পর প্রথম ৭ দিন প্রতি ৫০০০ রেণুর জন্য একমুঠ সুজি প্রতিদিন একবার সন্ধ্যায় দিতে হবে। কারণ চিংড়ি সাধারণত রাতেই আহার করে থাকে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৭ফেব্রু২০