চুক্তিভিত্তিক মুরগির খামার: ব্যয়-দায় সব কোম্পানির, আয় খামারির

278

বাজারে চাহিদা অনুযায়ী মুরগির সরবরাহ বাড়াতে নতুন বিপ্লব এনেছে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক পোল্ট্রি খামার।’ বিনা পুঁজিতে নিশ্চিত লাভের এ ব্যবসা মুরগির খামারিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ক্রমবিকাশমান এ খাতে ভিনদেশীদের আগ্রাসন ছাপিয়ে সেবা আর লাভে খামারিদের আস্থার শিখরে উঠে এসেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, করোনার আগে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মুরগির খামারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজার।

পরবর্তীকালে খাবার ও ওষুধের চড়া দাম, উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে মুরগি বিক্রি, রোগ বালাইয়ে খামারে মড়ক লাগাসহ হরেক কারণে ব্যক্তি পর্যায়ের অধিকাংশ খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কিছু সংখ্যক খামারি দেশী-বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনা (কেজি প্রতি উৎপাদন ফি) করছেন বলেও সংস্থাটির মাঠ পর্যায়ের তথ্য স্মারণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথাগত কৃষিপণ্য আর ঐতিহ্যগত আম উত্পাদনের ওপর নির্ভরশীল রাজশাহীর জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে চুক্তিভিত্তিক মুরগির খামার। আর এ ক্ষেত্রে খামারিদের কাছে অন্যতম আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস। খামারিদের মতে, মুরগির খামারের অতীতের সব ধ্যান-ধারণা বদলে দিয়েছে কোম্পানিটি। খামার স্থাপন থেকে শুরু করে মুরগি বিক্রি এবং খামারির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিশ্চিত আয় পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজী ফার্মসের চৌকস কর্মীরা সম্পৃক্ত থাকছেন। ফলে নির্দেশনা মেনে খামার পরিচালনা ব্যতিরেকে আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই খামারির। লাগছে না কোনো বিনিয়োগ, থাকছে না কোনো ঝুঁকিও।

সরেজমিন খামার ঘুরে কথা হলো গোদাগাড়ি হরিপুরের চকেরমাঠ গ্রামের খামারি মো. মোমিনের সঙ্গে। দিগন্তজোড়া খোলা মাঠের মাঝে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা খামারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি জানালেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মুরগির খামার করার তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতা।

‘ডিলারদের সঙ্গে মুরগির খামার করে কখনো কিঞ্চিৎ লাভ হলেও লোকসানের পাল্লা এত ভারী ছিল, যা মেটাতে দুই দফায় দুই ডিলারকে ভিটাসহ খামার লিখে দিতে হয়েছে,’ বললেন মোমিন।

অতীতের তিক্ততা ভুলে কলেজপড়ুয়া ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে কাজী ফার্মসের সঙ্গে খামারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তামান্না ইয়াসমিন ব্রয়লার ফার্মের স্বত্বাধিকারী মোমিন বলেন, ‘কাজীর সঙ্গে ২ হাজার ৫০০ মুরগির চারটি ব্যাচ শেষ হয়েছে। গড়ে প্রতিটি ব্যাচে ৭০ হাজার টাকা করে আয় করেছেন।’ তবে এক ব্যাচে ৯০ হাজার টাকা আয়ের তথ্য জানিয়ে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মোমিন বলেন, ‘এখন খামার করতে আমার কোনো চিন্তা নেই। সব দায়-দায়িত্ব কাজী ফার্মসের সংশ্লিষ্টরা কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। আমার চেষ্টা শুধু নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পরিমাণ খাবার দিয়ে বেশি ওজনের মুরগি উত্পাদন। চুক্তি অনুযায়ী ওজন যত বেশি, আমার আয় হবে তত বেশি।’

কাজী ফার্মসের সঙ্গে কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ে দিন বদলেছে পদ্মাপাড়ের গোদাগাড়ি উপজেলার নীলবোনা গ্রামের একসময়কার প্রান্তিক মত্স্যজীবী জাহাঙ্গীর আলমের। এক ব্যাচে দেড় হাজার মুরগিতে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় পাওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘কনট্রাক্টে খামার করে মুরগি মারা গেলেও আমার কোনো দায় নেই, লোকসান পুরোটাই নেয় কাজী ফার্মস। এতে করে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা লাভের টাকায় আগের দেনা মিটিয়ে নিজের ব্রেন টিউমারের চিকিত্সা করেছি, কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে কলেজপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, ১০ কাঠা জমি কিনেছি, আরও দেড় হাজারের ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন শেড নির্মাণকাজ অল্প দিনেই শুরু করব।’

মুরগির খামার ব্যবসায় ডিলার ও কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ভূমিকা প্রসঙ্গে রাজশাহীর মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভেটেরিনারি চিকিত্সক ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ডিলারদের একমুখী মুনাফা তুলে নেওয়ার চাপে কয়েক বছর আগেও এ অঞ্চলের খামার ব্যবসায় যে বিপর্যয় নেমেছিল, সে অবস্থা থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়েছে কনট্রাক্ট ফার্মিং। প্রসঙ্গত, মামুন বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোক্তাদের মাত্রাতিরিক্ত দামে ডিলারদের গছিয়ে দেওয়া পুষ্টিহীন বাচ্চা, গুণমানহীন খাবার আর যথেচ্ছা ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের চাপে ব্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খামারিদের শঙ্কার মধ্যে কাটত। তার ওপর ছিল মৃত্যুর আশঙ্কায় মেয়াদ শেষের আগেই মুরগি বিক্রির চাপ। সব মিলে খরচের তুলনায় কম দামে কম ওজনের মুরগি বেচে টাকা নিয়ে নিত ডিলার। ফলে ডিলারের খাতায় লোকসানের অংশ বাড়তে বাড়তে একসময় নিঃস্ব হয়ে ঋণের বোঝা নিয়ে ব্যবসা গুটিয়েছেন অনেক খামারি।

কিন্তু কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের কোম্পানিগুলোর দেওয়া কল্পনাতীত সুযোগ-সুবিধায় পুঁজিহীন ও ঝুঁকিবিহীন নিশ্চিত লাভের বাস্তবতায় মুরগির খামার ব্যবসায় পুরোনোরা ফিরে আসছেন, সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা। এ ক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মের অগ্রণী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, চুক্তিভিত্তিক মুরগি উত্পাদনের সব পর্যায়ে পুরো ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে কখনো কখনো মোটা অঙ্কের লোকসান গুনলেও ব্যাংকের হিসাবে খামারিদের মুনাফা পাঠায় নির্ধারিত সময়েই। এতে করে ব্যাপক উত্সাহ নিয়ে নিত্যনতুন খামারি যুক্ত হচ্ছেন এই ব্যবসায়।

এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর মাহমুদুল হাসান সিকদার বলেন, খামারে মুরগি উত্পাদন ব্যবসায় দেশি-বিদেশি কোম্পানি সম্পৃক্ত হওয়ায় অল্প সময়ে বড় সাফল্য দৃশ্যমান হচ্ছে। খামার নির্মাণ থেকে শুরু করে মুরগি উত্পানের সব পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। কোম্পানির প্রচেষ্টায় খামারিদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ছে। অযাচিত ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমছে। স্বাস্থ্যসম্মত মুরগির জোগান বাড়ছে। নিশ্চিত লাভ জেনে নতুন নতুন জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের পোলট্রি খাত শিল্পে রূপ নিয়েছে।