ছাগলের খামারের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। যেমন ব্রিডিং খামার, রেয়ারিং খামার, ফ্যাটেনিং খামার, ডেইরি খামার ইত্যাদি। দেশের জলবায়ু, পুঁজি দেশে বিদ্যমান বাজারের ধারনা মাথায় রেখে আপনাকে ব্যবসা শুরু করতে হবে। খামার শুরুর আগে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর বিষয়টা মাথায় রাখা জরুরী। যেমন আমাদের দেশে দুধ উৎপাদনকারী ছাগলের খামার করা অলাভজনক এবং বড় ঝুঁকির বিষয়। কারণ উন্নত জাতের ডেইরি গোট ব্রীড যেমন লামেনচা, নুবিয়ান, শানেন ইত্যাদি আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে সক্ষম নয়। বিধায় বাংলাদেশে বড় পরিসরে ডেইরি গোট ফার্ম করা সুবিধাজনক নয়। যদিও যমুনাপাড়ি দিয়ে ছোট পরিসরে ডেইরি ফার্ম করা যায়। তবে তাতে খরচ এবং লাভ সমান সমান হবার সম্ভাবনা থাকে।
আমার এখানে মূলত ছাগলের ব্রিডিং খামার এবং তার ব্যবসা কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
#ব্রিডিং খামার: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সব থেকে সহজ ছাগলের ব্রিডিং খামার প্রতিষ্ঠা করা। এ খামারে স্বল্প পরিচালন ব্যয়ে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব। ব্রিডিং খামারের মূল প্রোডাক্ট হচ্ছে ছাগলের বাচ্চা। অর্থাৎ খামারে উৎপাদিত ছাগলের বাচ্চার বয়স তিন মাস হয়ে গেলে তা বাজারজাত করা।
#ব্যবসায় কৌশল: ব্রিডিং খামারে বিশেষভাবে ফোকাসের জায়গাটা হচ্ছে উন্নত মানের, সুস্থ সবল বাচ্চা উৎপাদন। সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই উন্নত জাতের প্যারেন্ট স্টক সংগ্রহ করতে হবে। ব্রিডিং খামারের জন্য ক্রস ব্রীডের প্যারেন্ট স্টক সংগ্রহ করা উত্তম। সেক্ষেত্রে পাঁঠাটি কোন উন্নত জাতের ফুল ব্লাড অথবা পিউর ব্রীড সংগ্রহ করতে পারলে ভাল। যদিও উন্নত জাতের ফুল ব্লাডের পাঁঠার বাজার মূল্য অনেক। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বিষয়টা বেশ চাপের হতে পারে। কাজেই অল্প টাকায় ভাল জাতের সংকর পাঁঠা দিয়ে ভালভাবে কাজ চালানো যাবে বলে আমি মনে করি। এবারে খামার ব্যবস্থাপনার বিষয়টা পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হল।
১। স্থান এবং অবকাঠামো: খামারের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন এবং আধুনিক শেড নির্মাণ
২। প্যারেন্ট স্টক সংগ্রহ: উন্নত জাতের প্যারেন্ট স্টক সংগ্রহ করা। এক্ষেত্রে যমুনাপাড়ির সাথে ব্ল্যাক বেঙ্গলের ক্রস ব্রীডগুলো ভাল হবে। এই ছাগলের কানগুলো সাধারণত একটু লম্বা হয় এবং আকারেও আমাদের দেশি ছাগলের থেকে বড় হয়। তবে ছাগল ক্রয়ের সময় যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে তা হল
• চওড়া বুক
• গোল পেট
• প্রশস্ত যোনি
• বড় ওলান এবং সমান মাপের বাট
• পেছনের দু পায়ের মাঝখানের দূরত্ব এবং ছাগলের আকৃতি।
• গড় বয়স হবে ১৫- ১৬ মাস। অর্থাৎ ছাগলগুলো একটা গর্ভকাল অতিক্রম করেছে এমন স্টক খামারের জন্য সংগ্রহ করা লাভজনক।
• প্রতিটি পশুর পারিবারিক ইতিহাস জানতে হবে। অর্থাৎ ওই ছাগলের মা, দাদী, নানীর বাচ্চা প্রসবের সংখ্যা, বাচ্চার মান ইত্যাদি।
একটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, ছাগল ক্রয় করতে হবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে। দালাল বা হাট থেকে পশু সংগ্রহ করলে ঠকে যাবার সম্ভাবনা আছে।
৩। কৃমিমুক্তকরণ ও ভ্যাকসিন প্রদান:
• সংগ্রীহিত পশু খামারে নিয়ে আসার পর সঠিকভাবে ডিওর্মিং করতে হবে।
• বহি:পরজীবী যেমন উকুন,আঁটুলি ইত্যাদি দমন করতে হবে।
• প্রতিটি পশুকে পিপিআর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে।
৪। ট্যাগিং: প্রতিটি পশুকে আলাদা ভাবে সনাক্ত করার জন্য ট্যাগ করা বাধ্যতামূলক। পশুর কানে বা গলায় নম্বর সম্বলিত ট্যাগ লাগিয়ে দিলে পশুকে আলাদা ভাবে সনাক্ত করা, যত্ন নেয়া, চিকিৎসা করা সহজ হয়।
৫। পাঁঠা তৈরি: প্রজনন ঋতু আসার আগে পাঁঠাকে তৈরি করতে হবে। এসময় পাঁঠাকে প্রচুর পরিমাণে সবুজ খাবারের পাশাপাশি দানাদার খাবার দিতে হবে। দানাদার খাবার হিসবে শুধুমাত্র ভুট্টা, গম এবং ছোলা যথেষ্ট। অন্যকোন খাবার দিয়ে অপচয় করবেন না।
৬। প্রজনন: পাঁঠা প্রজননের জন্য তৈরি হলে ছাগীর কাছে প্রজননের জন্য নিয়ে আসতে হবে। এসময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে ছাগী গরম হয়েছে কিনা। ছাগী ভালভাবে গরম হওয়ার পরই প্রজনন করানো উত্তম। সেক্ষেত্রে ছাগী সকালে গরম হলে বিকালে প্রজনন করালে ভাল হবে। প্রজননের আগে ছাগীর স্বাস্থ্য এবং ওজন অবশ্যই উপযুক্ত থাকতে হবে।
৭। গর্ভধারণ কালের যত্ন: সাধারণত ছাগী কনসিভ করার ১৪৫ থেকে ১৫০ দিনের ভেতর বাচ্চা প্রসব করে। আপনার মূল কাজটা শুরু হবে বাচ্চা প্রসবের আগের ৬০ দিন। আপনার খামারের পশুর কানে নম্বর ট্যাগ থাকলে এই বিশেষ পরিচর্যার সময়গুলো সহজে নির্ধারণ করতে পারবেন। সুস্থ-সবল এবং নীরোগ বাচ্চা পেতে হলে গর্ভধারণ কালের শেষ দুইমাস যে কাজগুলো গুরুত্বের সাথে করতে হবে তা হল
• ছাগীকে পাল থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
• কৃমিনাশক দিতে হবে।
• বেশি চলাফেরা করতে দেয়া যাবে না। আধুনিক খামারে গর্ভধারণের শেষ দুইমাসের জন্য ছাগীকে শেডের ভেতর আলাদা ব্লকে রাখা হয়।
• সবুজ খাবারের পাশাপাশি দানাদার খাদ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে এবং অবশ্যই যাতে মিনারেল, ক্যালসিয়ামের পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। প্রয়োজনে বাজার থেকে মিনারেল ক্যালসিয়াম প্রিমিক্স কিনে দানাদার খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
• পশুকে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে।
• পশুকে সম্পূর্ণ রূপে মানসিক চাপমুক্ত রাখতে হবে।
• বাচ্চা বাচ্চা প্রসবের ১৪ দিন আগে ছাগীকে ড্রপিং প্যানে স্থানান্তর করতে হবে এবং পুনরায় কৃমিনাশক দিতে হবে।
• বাচ্চা প্রসবের আগ দিয়ে পশুকে ভালমতো রাত-দিন লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে করে বাচ্চা প্রসবের সময় পশুকে সাহায্য করা যায়। অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চা প্রসবে সাহায্যের অভাবে মা এবং বাচ্চা উভয়ই ঝুঁকিতে পরে যায়।
এখানে একটা বিষয় গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে যে কৃমিনাশক হিসাবে যে ঔষধটা দেয়া হচ্ছে তা গর্ভবতী ছাগীর জন্য নিরাপদ কিনা। প্রয়োজনে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কৃমিনাশক প্রয়োগ করবেন।
৮। প্রসব পরবর্তী যত্ন: বাচ্চা প্রসবের পর মূলত আপনার কাজ শুরু। মনে রাখতে হবে তিন মাস পর এসব বাচ্চাই আপনার খামারের পণ্য যা আপনাকে বাজারজাত করতে হবে। বাচ্চার এবং মায়ের প্রসব পরবর্তী যত্নসমূহ।
• বাচ্চা প্রসবের সাথে সাথে বাচ্চার নাক মুখ পরিষ্কার করে মায়ের সামনে দিতে হবে এবং বাচ্চাকে মায়ের শাল দুধ খাওয়াতে সাহায্য করতে হবে। কোনভাবেই বাচ্চাকে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরানো যাবে না। তা নাহলে মিস মাদারিং হতে পারে এবং যে বাচ্চা একবার মিস মাদারিং এর কবলে পরবে সে আর সুস্থ-সবল হয়ে বেড়ে উঠবে না।
• মায়ের প্রসব জনিত ধকল দ্রুত কাটবার জন্য মোলাসেস স্যালাইন এবং দানাদার খাবার দিতে হবে।
• দুইয়ের অধিক বাচ্চা হলে তৃতীয় বাচ্চাটিকে আলাদা ভাবে তোলা দুধ খাওয়াতে হবে।
• ছাগীর যথেষ্ট পরিমাণ দুধ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত সবুজ ঘাস এবং দানাদার খাবার সরবরাহ করতে হবে।
• বাচ্চার বয়স ২১ দিন হলে কৃমিনাশক দিতে হবে।
• মায়ের দুধের পাশাপাশি বাচ্চাকে সবুজ কচি ঘাস খাবার অভ্যাস করাতে হবে।
৯। বাচ্চা বাজারজাত করার আগের মাসের বিশেষ যত্ন: বাচ্চার বয়স দুই মাস হলে মায়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলতে হবে। বাচ্চাকে কৃমিনাশক দিতে হবে। সবুজ ঘাসের পাশাপাশি দানাদার খাবার হিসাবে ৬০-৭৫ গ্রাম করে ভুট্টা এবং গম ভাঙ্গা দিতে হবে। সাথে ভিটামিন প্রিমিক্স মেশানো যেতে পারে। এতে করে বাচ্চার চেহারা এবং ওজন বাড়বে। মোটা দাগে বলতে গেলে বাচ্চার বয়স দুই মাস থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত বাচ্চার খাদ্য ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে।
১০। বাজারজাতকরণ ও লাভ-লোকসান: খামার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আপনাকে আপনার খামারের পরিচিতি বাড়াতে হবে। সবথেকে ভাল মাধ্যম হল ফেসবুক। ফেসবুকে একটি পাতা খুলে আপনি যে একজন ব্রীডার তা ব্র্যান্ডিং করতে পারেন। তাছাড়া স্থানীয় ভাবে আপনি বাচ্চা বিক্রয়ের জন্য আগে থেকে বাজার তৈরি করে রাখতে পারেন। সত্য বলতে গেলে এ ধরনের ব্যবসা শুরু করলে অটোমেটেড ভাবে ব্র্যান্ডিং হয়ে যায়। আর একবার আপনি ভাল বাচ্চা সরবরাহ করতে পারলে আপনার বাজার তৈরি হয়ে যাবে। এবার কথা বলা যাক বাচ্চার বাজার মূল্য নিয়ে। জাত ভেদে ছাগলের বাচ্চা ১৫০০ থেকে শুরু করে ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। সেক্ষেত্রে খামারের বিনিয়োগ ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা নির্ভর করে। যেহেতু আমি শুরুতেই বলেছি সংকর জাতের ছাগীর সাথে উন্নত জাতের পাঁঠার প্রজনন ঘটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করতে সেহেতু এই বাচ্চাগুলোর বাজার মূল্য আসবে নূন্যতম ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকার ভেতর। এক্ষেত্রে বাচ্চার ওজন, স্বাস্থ্য এবং চেহারা গুরুত্ব রাখবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রতি ছাগী প্রতি মাসে ২০০ (দুইশত টাকা) (ছাগলের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় খরচের বিষয়টা বিস্তারিত লিখব) খরচ করে পাঁচ মাসে (গর্ভধারণ কাল) আপনার খরচ দাঁড়াবে ১,০০০ (এক হাজার টাকা)। আর এদিকে ধরলাম আপনি ওই ছাগী থেকে নূন্যতম দুটি বাচ্চা পেলেন এবং প্রতিটি নিদেনপক্ষে ৩,০০০ (তিন হাজার টাকা) করে বিক্রি করলেন। তাহলে আপনার লাভ থাকল ৫০০০ (পাঁচ হাজার টাকা)। আপনার খামারে যদি ৫০ টি ছাগল থাকে সেক্ষেত্রে আপনার একটি ল্যাম্বিং পিরিয়ডে মোট লাভ থাকছে ,২৫০,০০০ (দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা)। আপনি প্রতি বছর দুটি করে ল্যাম্বিং পিরিয়ড পাবেন। সে হিসাবে আপনার ভবিষ্যতের জন্য স্টক রেখে বাকি সমস্ত বাচ্চা আপনি বিক্রি করে দিতে পারেন।