ছাদে যে সকল গাছ বপন করলে ভালোঃ
ছাদে বাগান করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন গাছটি বড় আকারের না হয়. অর্থাৎ ছোট আকারের জাতের গাছ লাগাতে হবে এবং গাছে যেন বেশি ফল ধরে সে জন্য হাইব্রিড জাতের ফলদ গাছ লাগানো যেতে পারে. আম্রপালি ও মলি্লকা জাতের আম, পেয়ারা, আপেল কুল, জলপাই, করমচা, শরিফা, আতা, আমড়া, লেবু, ডালিম, পেঁপে, এমনকি কলা গাছও লাগানো যাবে. ছাদ বাগানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, গাছ বাছাই. জেনে, বুঝে, বিশ্বস্ত নার্সারি, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে গাছ সংগ্রহ করতে হবে. বেঁটে প্রজাতির অতিদ্রুত বর্ধনশীল ও ফল প্রদানকারী গাছই ছাদ বাগানের জন্য উত্তম. বীজের চারা নয়, কলমের চারা লাগালে অতিদ্রুত ফল পাওয়া যায়. আজকাল বিভিন্ন ফলের গুটি কলম, চোখ কলম ও জোড় কলম পাওয়া যাচ্ছে. ছাদ বাগানের জন্য এসব কলমের চারা সংগ্রহ করতে পারলে ভালো হয়. টবে আমের মধ্যে আম্রপালি, আলফানসো, বেঁটে প্রজাতির বারোমেসে, লতা, ফিলিপাইনের সুপার সুইট, রাঙ্গু আই চাষ করা যেতে পারে. লেবুর মধ্যে কাগজিলেবু, কমলা, মালটা, নারকেলি লেবু, কামকোয়াট, ইরানিলেবু, বাতাবিলেবু (অ্যাসেম্বল) টবে খুবই ভালো হয়. এ ছাড়া কলমের জলপাই, থাইল্যান্ডের মিষ্টি জলপাই, কলমের শরিফা, কলমের কদবেল, ডালিম, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল, নারিকেলকুল, লিচু, থাইল্যান্ডের লাল জামরুল, গ্রিন ড্রপ জামরুল, আপেল জামরুল, আঙ্গুর পেয়ারা, থাই পেয়ারা, ফলসা, খুদে জাম, আঁশফল , জোড় কলমের কামরাঙা, এমনকি ক্যারালা ড্রফ প্রজাতির নারিকেলের চাষ করা যেতে পারে. সঠিক মানের চারা হলে এক বছরের মধ্যেই ফল আসে. আজকাল বিদেশ থেকে উন্নত মানের কিছু চারা কলম দেশে আসছে. ছাদ বাগানের সাধ পূরণ করার জন্য এসব সংগ্রহ করে লাগাতে পারেন. বাহারি পাতার জামরুল, পেয়ারা, সফেদা গাছও বিভিন্ন নার্সারিতে এখন কিনতে পাওয়া যাচ্ছে. ছাদে এসব গাছ লাগানো হলে ছাদ বাগানের সৌন্দার্য বৃদ্ধি পায়.
টব পদ্ধতি:
দরকার মতো সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো যায়. ছাদে টবে গাছ লাগানো অনেকেই পছন্দ করেন. টবে সার-মাটি দেওয়া খুব সহজ. আজকাল অনেকেই পোড়ামাটি এবং প্লাস্টিকের টব ব্যবহার করেন. আবার টবের গায়ে রং দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো যায়. টবে গাছ লাগানোর সময় মনে রাখতে হবে যেন ওই গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টবের অল্প মাটিতেই ওই গাছের খাদ্যপুষ্টি থাকে.
হাফ ড্রাম :
বড় আকারের ড্রামের মাঝামাঝি কেটে দুই টুকরো করে বড় দুটি টব তৈরি করা যায়. বড় জাতের এবং ফলের গাছের জন্য হাফ ড্রাম ভালো. এগুলো সরাসরি ছাদের ওপর না বসিয়ে কয়েকটি টুকরো ইটের ওপর বসানো দরকার. অনেকে মনে করেন, ছাদের ওপর হাফ ড্রাম রাখলে ছাদের ক্ষতি হয়. এ ধারণা সঠিক নয়.
চৌবাচ্চা :
ছাদে এক থেকে দেড় ফুট উঁচু এবং তিন থেকে চারটি পিলারের ওপর পানির ট্যাঙ্ক বা চৌবাচ্চা আকারের রিং স্লাব বসিয়ে ইটের টুকরো এবং সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী চৌবাচ্চা তৈরি করা যায়. এই ধরনের চৌবাচ্চায় মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ চাষ করে ছাদের পরিবেশ সুন্দর রাখা যায় সহজেই.
স্থায়ী বেড পদ্ধতি :
ছাদের কোনো অংশে স্থায়ী বাগান করতে চাইলে সুবিধামতো আকারের স্থায়ী বেড তৈরি করা যায়. তবে চার ফুট দৈর্ঘ্য, চার ফুট প্রস্থ এবং দুই ফুট উচ্চতার বেড তৈরি করা ভালো. এ ধরনের বেড তৈরি করতে নিচে পুরু পলিথিন দিয়ে ঢালাই করলে ছাদ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না.
টবের প্রস্তুত পদ্ধতি :
ফুল কিংবা ফল গাছ যাই হোক না কেন, টব ব্যবহার করার সময় লক্ষ রাখতে হবে, গাছের আকার কত বড় হবে. সেই মতো টবের আকার নির্ধারণ করা দরকার. পানি গড়িয়ে যাওয়ার জন্য টবের নিচে ছিদ্র থাকতে হবে. ছিদ্রের ওপর নারকেলের ছোবড়া বা ইটের টুকরো দিয়ে ঢেকে দিতে হবে. টবে ব্যবহারের আগে ছোবড়া বা ইটের টুকরো ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে. গরম পানিতে ধুয়ে নিতে পারলে ভালো. যে গাছের চারা লাগানো হবে তা সাধারণ পানিতে ধুয়ে নিতে হবে. এর ফলে রোগের সংক্রমণ অনেক কমে যায়. চারা কেনার সময় অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের চারা সংগ্রহ করা দরকার. গাছ বড় হলে প্রয়োজনে বড় টবে সাবধানে চারা স্থানান্তর করে নেওয়া যায়. তবে টব ভেঙে চারা গাছ বের করা যাবে না. মনে রাখতে হবে, চারা গাছটি যেন কোনোভাবেই আঘাত না পায়.
টবের সার-মাটি :
টবের গাছের খাদ্যপুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য মাটিতে দরকারি সার মেশাতে হবে. মাটি, গোবর সার, কম্পোস্ট, পচা পাতা, পরিমাণমতো রাসায়নিক সার মেশাতে হবে. শুকনো দূর্বা ঘাস টবের মাটির মাঝামাঝি দিয়ে তার ওপরে মাটি দিয়ে চারা গাছ লাগানো ভালো.
যত্ম সেবা :
যেহেতু সীমিত আকারে, সীমিত জায়গায় উৎপাদন করা হয় সেজন্য অতিরিক্ত যত্ম সেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিভিন্ন পরিচর্যায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে. বিশেষ করে সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি. কেননা সার কমবেশি হলে, গাছের গায়ে লেগে গেলে গাছ মরে যাবে, পরিমাণ মতো না হলে অপুষ্টিতে ভুগবে.
টবের ক্ষেত্রে ছোট গাছ বড় হলে পট / টব বদল, ডিপটিং (পুরানো টবকে আলতো করে মাটিতে শুইয়ে গড়াগড়ি দিলে গাছটি টব থেকে বেড়িয়ে আসবে. পরে অতিরিক্ত মূল কেটে মাটি বদলিয়ে সার প্রয়োগসহ নতুনভাবে গাছ বসানো) করতে হবে সময়মতো. বছরে অন্তত একবার পুরাতন মাটি বদলিয়ে নতুন মাটি জৈব সারসহ দিতে হবে. ইদানিং বাজারে টবের মাটি কিনতে পাওয়া যায়. মানসম্মত মাটি কিনে টবে / পটে / ড্রামে ভরতে হবে.
খুব সাবধানতার সাথে টব / পটে / ড্রামে চারা / কলম / বীজ লাগাতে হবে. ঠিক মাঝখানে পরিমাণ মতো মাটির নিচে রোপন করতে হবে. চারা বা কলমের সাথে লাগানো মাটির বল যেন না ভাঙ্গে সেদিকে নজর রাখতে হবে. চারা বা কলমের ক্ষেত্রে বীজতলা / নার্সারিতে যতটুকু নিচে বা মাটির সমানে ছিল ততটুকু সমানে ছাদে লাগাতে হবে. বীজতলার থেকে বেশি বা কম গভীরে লাগালে গাছের বাড়বাড়তিতে সমস্যা হবে. মাঠে ফলমুল সবজি চাষের চেয়ে ছাদে সবজি চাষের অনেক পার্থক্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা. বাগানে প্রতিদিন পরিষ্কার কার্যক্রম অনুসরণ করতে হবে. সেজন্য পুরাতন রোগাক্রান্ত, বয়স্ক ডালপালা, পাতা সাবধানতার সাথে কেটে নির্দিষ্ট স্থানে জমা করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে. এতে গাছপালা রোগমুক্ত থাকবে ফলনে সুবিধা হবে. ফুল এবং সবজিতে প্রয়োজন মাফিক সার প্রয়োগ করতে হবে. কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে অন্তত দু’বার (একবার বর্ষার আগে একবার বর্ষার পরে ) সাবধানে পরিমাণমত সার দিতে হবে. সার প্রয়োগের সময় মাটির আর্দ্রতা দেখে নিতে হবে. কেননা বেশি আর্দ্র বা কম আর্দ্র কোন টাইপের সার প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত নয়. বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু কিছু সার পানিতে মিশিয়ে গাছ ছিটিয়ে দিতে হবে. গুঁটি সারও এ ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী.
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কোন ফলে পোকা বা রোগের আক্রমণ অহরহ ঘটে থাকে. সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে. প্রতিদিন ২/৩ বার যদি বাগান পরিদর্শন করা যায় তাহলে বালাই আক্রমণ যেমন কম হবে তেমনি ফসলও পাওয়া যাবে অনেক. সুতরাং লাভ বেশি হবে. যদি হঠাৎ বেশি মারাত্মক আক্রান্ত হয়ে যায় তখন উপযুক্ত বালাইনাশক সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে.
সেচ ও নিস্কাশন :
ছাদে / টবে সেচ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়. কেননা মাটির আর্দ্রতার জন্য সহজেই গাছ নেতিয়ে যাবে । তেমনি অতি পানি বা পানির আর্দ্রতার জন্যও গাছ নেতিয়ে পড়ে মরে যেতে পারে. তাই অবশ্যই ছাদের বাগানে প্রতিনিয়ত সেচের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে. ছাদের বাগানে সেচের জন্য ক্সিকিলার অর্থাৎ ঝাঁঝরি দিয়ে সেচ দেয়া ভালো. তাছাড়া প্লাস্টিকের চিকণ পাইপ দিয়েও পানি সরবরাহ বা দেয়া যায়. এক্ষেত্রে ডেলিভারি পাইপের মাথায় চাপ দিয়ে ধরলে পানি হালকাভাবে ছিটিয়ে পরে সুতরাং ইচ্ছে করলে ঐ পদ্ধতিও অনুসরণ করা যায়.
জীবনের প্রয়োজনে মানুষ অনেক নতুন তথ্য প্রযুক্তি আবিষ্কার করে. শখের বিলাশী ঘটনাও সময়ের ব্যবধানে আবশ্যকীয় হয়ে যায় এবং সর্বজনবিদিত উপকারি ও জনপ্রিয় হয়ে যায়. ছাদের বাগানও তেমন. সময়ের প্রয়োজনে জীবনের প্রয়োজনে সবাই এক চিলতে জায়গাও খালি রাখতে চায় না. প্রতি ইঞ্চি জায়গাকে যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করতে চায়. দিন বদলের পরিক্রমায় অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ছাদের বাগান একটি আবশ্যকীয় প্রযুক্তি পদ্ধতি হয়ে স্থান পাবে. সবচেয়ে বড় কথা ছাদে বাগানকে একটি অতিরিক্ত লাভ হিসেবে পরিগণিত করা যায়.
তাই আমাদের যার যার সুযোগ আছে, সে সুযোগকে যৌক্তিকভাবে কার্যকর ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের বহুমুখী লাভ হবে. আসুন আমরা সবাই এ সুযোগের আওতায় সর্বোচ্চ লাভ ঘরে তুলি, কৃষিকে সমৃদ্ধ করি দেশেকে সমৃদ্ধ করি ।
ছাদে বাগানের কিছু জরুরি টিপস:
.লম্বা গাছকে ছোট গাছের পিছনে রাখতে হবে.
. টবে বা ফ্রেমে খৈল দেয়া যাবে না, এতে পিঁপড়ার উপদ্রব বাড়তে পারে.
. বাজার থেকে কেনা প্যাকেটজাত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ভালো.
. বছরে একবার নতুন মাটি দিয়ে পুরাণ মাটি বদলিয়ে দিতে হবে. এটি অক্টোবর মাসে করলে ভালো.
. ছাদে বাগানের জন্য মিশ্র সার, গুঁটি ইউরিয়া, খৈল, হাড়ের গুঁড়া (পচিয়ে) ব্যবহার করা ভালো.
. বাজারে স্টিল লোহার ফ্রেম পাওয়া যায়. এগুলো দিয়ে অনায়সে ছাদে বাগান করা যায়.
. অবস্থা বুঝে গাছের গোড়ায় চুনের পানি সপ্তাহে ১ বার ব্যবহার করা যায়
গ্রীষ্মকালে বাড়ির ছাদে যেসব সবজি চাষ করবেন:
অনেকেই নিজের বাসার সামনে বা পেছনের খালি জায়গাতে বা বাড়ির ছাদে সবজি চাষ করে থাকেন। আপনার বাসার পিছনে কিংবা বাড়ির ছাদে যদি জায়গা থাকে তাহলে বিভিন্ন রকমের মৌসুমি সবজি লাগাতে পারেন। বর্তমান সময়টা যেহুতু গরমের সেহেতু এমন সবজি লাগাতে হবে যা উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন থেকে জেনে নিতে পারেন এই গরমে বাড়ির ছাদের স্বল্প পরিসরের জায়গায় কী কী সবজি লাগানো যায় সে সম্পর্কে-
১। মটরশুটি-
সালাদ এবং অন্যান্য অনেক খাবারে ব্যবহার হয় এই সবজি। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে মটরশুটি। জুন-জুলাই প্রকৃত সময় মটরশুটি চাষের। তাই স্বল্প পরিসরে চাষ করার জন্য মটরশুটি উত্তম।
২। শসা-
সবজি এবং ফল, দুভাবেই শসার মূল্যায়ন করা যায়। এর জন্য গরম আবহাওয়া যথোপযোগী। বাড়ির পিছনে শসা লাগালে ভিটামিনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আপনার বাসার সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পাবে।
৩। টমেটো-
টমেটো শীতকালীন সবজি। গরমেও এর চাষ করা যায়। টমেটো খুব সহজে পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাই কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
৪। বেগুন-
টমেটোর মতো বেগুনও শীতকালীন সবজি হলেও গরমে চাষ করা যায়। দুটো বেগুণের চারা পাশাপাশি না লাগিয়ে কিছুটা দূরত্বে লাগাতে হবে। বেগুনগাছ লাগানোর প্রকৃত সময় জুন-জুলাই।
৫। মরিচ-
মরিচ চাষের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো- রোদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্দ্রতা এবং সুষম মাটি। গাছে ফুল আসা মাত্রই জৈব সার ব্যবহার করুন।
৬। ভুট্টা-
একটি আরেকটি পুষ্টিকর খাবার যা গরমকালে চাষ করা হয়। ভুট্টার পরাগায়নের জন্য গ্রীষ্মকালের বাতাস খুব জরুরি। বিভিন্ন খাবারে ভুট্টার ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া গরম করেও ভুট্টা খাওয়া যায়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২১মার্চ২০