জানা গেলে ডিম মুরগির দাম বাড়ার আসল কারণ!

335

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে বিপাকে দেশের জনগণ। ডিম সাড়ে ১২ টাকা প্রতিপিস, ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা। এ যেন ঝড়ের মুখে বিশাল দৈত্য! জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণেই বেড়েছে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম-এমনই ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু পোল্ট্রি পণ্যের দাম বাড়ার আসল কারণ কি?

ডিম মুরগির দাম বাড়ার আসল কারণ কী? জানতে বাংলাদেশের পোল্ট্রি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সংগঠন ও ডিম উৎপাদনকারী প্রান্তিক খামারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিস্তারিত তথ্য।

প্রথমে ডিম-মুরগির দাম বাড়ার কারণ জানতে কথা হয় বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহসীন আলীর সাথে। তিনি বলেন, খামারিরা করোনাকাল থেকেই লোকসান দিয়ে আসছে। এরমধ্যে কিছু সময় সামান্য দাম বাড়লেও তা দিয়ে খামার টেকানো সম্ভব হয়নি। ফলে ৫০ শতাংশের বেশি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশ থেকে পোল্ট্রি ফিড তৈরির উপাদান যেমন সয়াবিন মিল, ভুট্টা, প্রোটিন আমদানি করতে হয়। এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। কিন্তু ডিম-মুরগির দাম বাড়েনি। অথচ সে সময় বাড়ানো যৌক্তিক ছিল। এখন বাজারে কিছু সময়ের জন্য মুরগি সরবরাহ কমেছে ফলে দাম বাড়া স্বাভাবিক।

কথার সত্যতা যাচাইয়ে রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: এনামুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বর্তমানে পোল্ট্রি খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে রাজশাহীর ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ডিম পাড়া লেয়ার মুরগির খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ব্রয়লারের ৮০ শতাংশ খামার বন্ধ। তারা উৎপাদনে ফিরতে পারেন নি। ফলে বাজারে মুরগির টান পড়েছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লেয়ার খামারিরা এখন একদিন বয়সের বাচ্চা তুলতে শুরু করেছেন। যা উৎপাদনে আসতে সময় লাগবে ১৫০ দিন। এছাড়া খামারিরা যেভাবে লোকসানে ছিলেন নতুন দামে ডিম-মুরগি বিক্রি করে তা পুষিয়ে নিতে পারবেন।

গত ২ বছরের ব্যবধানে দফায় দফায় পোল্ট্রি খাদ্যের দাম বৃদ্ধি খামারিদের নাজেহাল করে তুলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মোট চতুর্থবারের মতো বেড়েছে পোল্ট্রি খাদ্যের দাম। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের নিবন্ধিত ২৭০টি ফিড মিল তাদের উৎপাদিত খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিকেজি খাদ্যে মধ্য মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত দাম বেড়েছে ২ থেকে আড়াই টাকা। ফলে ৫০ কেজির বস্তা ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে খামারিদের।

খামারিরা বলছেন, করোনাকালের শুরু থেকে প্রতিবস্তা পোল্ট্রি খাদ্যে ১০০০ থেকে ১২৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা শুরুর দিকে ১৮’শ টাকার খাদ্যের বস্তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩২’শ ৫০ টাকায়।

রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা এলাকার পোল্ট্রি খামারি সোহেল রানা জানান, “একটা পূর্ণ বয়স্ক ডিম দেওয়া লেয়ার মুরগি দিনে ১৮০ থেকে ২২০ গ্রাম খাবার খায়। ৬টি মুরগি খাবার খায় ১ কেজি খাদ্য। আগে ১ কেজি খাবার ৫০ টাকায় পাওয়া যেতো অর্থ্যাৎ ৫০ কেজির বস্তা ২০০০ টাকায় হয়ে যেতো। একই খাদ্য এখন কিনতে হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা দরে।

এই খামারি বলেন, আগে প্রতিপিস ডিম উৎপাদনে খরচ হতো ৭ টাকা। আর বিক্রি হতো ৭ টাকা ৯০ পয়সা কিংবা ৮ টাকায়। এখন একই ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে সাড়ে ৮ টাকার উপরে। আর বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। ১ হাজার মুরগি খাবার খেলে ১০০০ ডিম পাওয়া যায় না। ৯০ শতাংশ ডিম পেলে ১ টাকা করে লাভ হয়। এখন যারা বলছেন ডিমের দাম কেন বেড়েছে তাদের কাছে প্রশ্ন- শুধু খাবার খাইয়েই মুরগি পালন সম্ভব? নাকি শ্রমিক, ঔষুধ, ভ্যাকসিন, পরিবহন আছে?

আরেক খামারি সাজিদ হোসেন বলেন, ডিম দেওয়া ১ হাজার লেয়ার পালন করতে বা খামার করতে ৮ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এখন আমরা দিনে ১ হাজার টাকা লাভ করছি দাম বাড়ার পরে। এতগুলো টাকা ইনভেস্ট করে যদি এ সামান্য লাভ না আসে তাহলে আমাদের সংসার চলবে কিভাবে? সবকিছুর দাম বাড়তি কিন্তু কিছুদিন আগেও আমরা সাড়ে ৭ টাকা দামে ডিম বিক্রি করেছি। মহাজনের কাছে ৮ লাখ ১০ লাখ টাকা বাঁকি!

ফিডের দামের সত্যতা যোগাযোগ করা হয় দেশের বৃহৎ পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাজী ফিডের বিপনন বিভাগের প্রধান সালাউদ্দিন হাওলাদারের সাথে। তিনি জানান, বর্তমানে ব্রয়লার স্টার্টার ফিড ৩ হাজার ১৬০ টাকা, ব্রয়লার গ্রোয়ার ৩ হাজার ১৯৫ টাকা, ব্রয়লার পুলেট ৩ হাজার ১৫৫ এবং ব্রয়লার ফিনিশার ৩ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে অন্তত ৭০০ টাকা কম ছিল। সবকিছুর দাম বাড়ায় বেড়েছে ডিম-মুরগির দাম। এতে ফিড মিলাররা কিছু করতে পারবে না। কারণ সবগুলোই বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়।

তবে, কিছু অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পোল্ট্রি সেক্টরে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম রয়েছে। প্রান্তিক খামারিরা আসলে কতটা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছেন সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়। তাদের অভিযোগ ডিমের দাম বাজারে বেশি হলেও খামারিদের কাছে থেকে কম দামে কেনা হয়।

জানা যায়, মূলত দামের চাবিটা নাড়ায় হাতেগোনা কয়েকজন। গুটিকয়েক পোল্ট্রি কোম্পানির কারসজিতেই হুটহাট দাম বাড়ে আবার কমে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটবড় পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠলেও রাজধানীর টঙ্গী, বোর্ড বাজার, জয়দেবপুর ও গাজীপুরে দেশের সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। মূলত এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজার।

এই সিন্ডিকেটে রাজশাহী অঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছেন মো: জয়নাল আবেদিন। রাজশাহী শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পূর্ব দিকে জেলার পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের মোসলেমের মোড়ের একটি আড়তে তিনি বসেন। আর এ অঞ্চলের খামারিদের কাছে থেকে ডিম আনা হয় তাঁর কাছে। এখান থেকেই ট্রাকভর্তি ডিম যায় ঢাকার বাজারে। জয়নাল আবেদিনের আরেক পরিচয় তিনি পোল্ট্রি ফিডের ডিলার ও ফিড মিল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।

জয়নাল আবেদিন বলেন, ডিমের দাম বাড়ানো কমানোর দায় আমার কাছে নেই। প্রতিদিন ঢাকা থেকে যে রেট দেওয়া হয় খামারিদের কাছে সেই রেটের ৫০ পয়সা কম রাখা হয়। কারণ আমাদের খরচ আছে। যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয় আসলে সেরকম কিছু নেই। তবে, বড় বড় কোম্পানি তাদের নিজস্ব উৎপাদিত খাদ্য দিয়ে ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে ফলে তাদের খরচ কম হয়। প্রান্তিক খামারিরা যদি বড় কোম্পানির আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে একচেটিয়া তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। বর্তমানে তারাই সেটা করছে।

ডিম-মুরগির দাম বাড়ায় ব্যবসায় লাভ বেড়েছে পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের। রাজশাহীর সাহেববাজারের ব্যবসায়ী শামীম হোসেন বলেন, ডিম-মুরগির দাম বাড়লে ব্যবসা ভালোই হয়। আমরা ছোট ব্যবসায়ীরা মাল স্টক করে রাখার সুযোগ নেই। মোসলেমের মোড়ে ১০ লাখের বেশি ডিম জড়ো হয়। একদিন পর যদি তারা গাড়ি পাঠায় তাহলে তাদের লাভ হবে। কিন্তু আমাদের তা সুযোগ নাই।

রাজশাহীর বাজারে বর্তমানে লাল ডিমের হালি ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা। আর সাদা ডিম ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। সোনালি ২৮০ টাকা, কক মুরগি ২৭০ টাকা, হাঁস ৪৫০ টাকা, রাজহাঁস ৪৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। দাম আরো বাড়বে এটা নিশ্চিত।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৬আগস্ট ২০২২