জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে রাজহাঁস পালন

1007

পোল্ট্রির প্রজাতিগুলোর মধ্যে পানিপ্রিয় একটি প্রজাতি হলো রাজহাঁস, যার বৈজ্ঞানিক নাম Anser anser. রাজহাঁস মূলতঃ মাংস উৎপাদনের জন্যই পালন করা হয় । এরা মৌসুমী ডিম উৎপাদক, সাহসী এবং অধিক জীবনীশক্তি সম্পন্ন একধরনের পাখি যা প্রতিকুল আবহাওয়া ও পরিবেশে পালন করা যায় । এটি বাংলাদেশের সর্বত্রই কম বেশী পাওয়া যায়। তবে প্রথাগতভাবে কিছু কিছু এলাকা রাজহাঁস পালনে সমৃদ্ধ যেমন- পটুয়াখালীর কলাপাড়া, মেহেরপুরের মুজিবনগর, নওগাঁর সান্তাহার এলাকা, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ইত্যাদি । এছাড়া সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নীলফামারী যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ ইত্যাদি জেলাতেও রাজহাঁস পালন করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণতঃ সদা ও ধুসর এই দুই ধরনের দেশী জাতের রাজহাঁস দেখা যায় । সাদা জাতের উৎপত্তি Chinese goose থেকে আর ধুসর বর্নগুলোর Wild grey goose থেকে । প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় প্রায় ৪০০০ বছর আগে থেকে রাজহাঁস পালনের প্রচলন ছিল এবং এগুলোর একটির ওজন প্রায় ১০-১২ কেজি পর্যন্ত হতো । প্রধানত মাংশ উৎপাদনের জন্য রাজহাঁস পালন করা হতো । এরা প্রায় ৫০টি ডিম পাড়ত যেখানে একটি Wild goose ডিম দিত মাত্র ১২-১৫টি। এদেশে পালন করা হয় এমন কিছু সাদা ও ধুসর জাতের রাজহাঁসের ছবি নিন্মে দেয়া হলোঃ

ab                                  সাদা রাজহাঁস                                                       ধূসর রাজহাঁস

পোল্ট্রির অন্তর্ভূক্ত ১১টি প্রজাতির (মুরগী, হাঁস, রাজহাঁস, কবুতর, তিতির, কোয়েল, গিনিফাউল অন্যতম) মধ্যে রাজহাঁস হচ্ছে একমাত্র প্রজাতী যা গরু-ছাগলের ন্যায় ঘাস/লতাপাতা খেয়ে থাকে। সাধারণতঃ রাজহাঁস ও তিতির ছাড়া অন্য প্রজাতীগুলো ঘাস খেতে পছন্দ করে না । রাজহাঁস প্রায় তার প্রয়োজনীয় খাদ্যের অর্ধেকের বেশি খাদ্য ঘাস খেয়ে পূরণ করে থাকে। এটি পালন করার জন্য তৃণময় নিম্নভূমি বিশিষ্ট এলাকা প্রাধান্য পেয়ে থাকে । এ জন্য তৃণময় এলাকায় রাজহাঁস পালন করলে খাদ্য খরচ কম হয়। এক সমীক্ষায় আমরা দেখেছি যে, আমাদের দেশী জাতের রাজহাঁস সারা বছরে প্রায় ২০-২২ টি ডিম দিয়ে থাকে । তবে মজার ব্যাপার হলো এ ডিমের আকার এত বড় যে, তা দেশী হাঁসের চেয়ে আড়াই গুণ এবং মুরগীর ডিমের তুলনায় প্রায় ৪গুণ বড় । এ হিসেবে ১টি রাজহাঁসীর এক বছরের ডিমের পরিমাণ দাড়ায় প্রায় ৮০টি মুরগীর ডিম বা ৫৫টি হাঁসের ডিমের সম পরিমাণ ।

রাজহাঁস সাধারণত শীতের শুরুতে ডিম পাড়া আরম্ভ করে । একদিন পর পর একটানা ১০-১৪টি ডিম দেয় এবং প্রায় মাসখানেক বিরতিতে ২য় বারে আবার ডিম দিয়ে থাকে । তবে সাধারণতঃ ২য় বারে প্রথম বারের তুলনায় কিছুটা কম ডিম দিয়ে থাকে। সুতরাং এরা বছরের প্রায় ৪ মাস (বাংলা, কার্তিক-মাঘ বা ইংরেজী, মধ্য নভেম্বর থেকে মার্চ) পর্যন্ত ডিম দেওয়া, বাচ্চা ফুটানো ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকে । রাজহাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ৩০/৩১ দিন । রাজহাঁসের ডিম মুরগী ও হাঁসের ন্যায় প্রকৃতিক ও কৃত্রিম এই দুটো পদ্ধতিতে ফুটানো যায় । প্রকৃতিক পদ্ধতিতে রাজহাঁসীর নিচে ডিম বসিয়ে বাচ্চা ফুটানো যায়। যা ছোট খামারী বা কৃষক ভাইদের জন্য প্রযোজ্য কারণ এভাবে মাত্র ৭-১০টি ডিম ফুটানো সম্ভব । কৃত্রিম পদ্ধতিতে ডিম ফুটানোর জন্য রাজহাঁসীর কোন প্রয়োজন নেই । এক্ষেত্রে ডিম ফুটানোর যন্ত্র বা ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানো যায়। সাধারণত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেশী সংখ্যক রাজহাঁসের বাচ্চা ফুটানোর জন্য এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় । উল্লেখ্য যে, উভয় পদ্ধতিতে ডিম থেকে বাচ্চা পেতে একই সময় লাগে ।

সমীক্ষায় আমরা আরো দেখেছি যে, ১০০টি রাজহাঁসের বাচ্চা ৩ মাস পালন করে বিক্রি করলে খরচ বাদে লাভ পাওয়া সম্ভব প্রায় ১৫,০০০-২০,০০০ টাকা । আমি বলব এটি অবশ্যই একটি পরিবারের জীবন ও জীবিকার জন্য একটি অন্যতম আয়ের উৎস হতে পারে । সুতরাং গ্রামীন যুবক/মহিলারা রাজহাঁসের মৌসুমী খামারের মাধ্যমে আর্থিক লাভবান হতে পারেন । জীবন ও জীবিকার জন্য রাজহাঁস পালন বলতে এখানে কতগুলো বিষয়কে বুঝানো হয়েছে যেমন অঞ্চল বিশেষ রাজহাঁস পালতে খাদ্য খরচ তেমন নেই বললেই চলে; কারণ খামারীরা তাদের রাজহাঁসের খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ, কচি ধানের ডগা, কচুরী পানা, ক্ষুদে পানা, দূর্বা, শ্যামা, পাতাকপি ইত্যাদি খাইয়ে থাকে । দানা খাদ্য হিসেবে চালের কুড়া, খুদ, গম ইত্যাদি সামান্য পরিমানে দিয়ে থাকে । তবে এ ক্ষেত্রে পুষ্টির উপাদানগুলোর কথা বিবেচনায় রেখে সুষম খাবার প্রদানের মাধ্যমে খামারীরা বেশী লাভবান হতে পারেন । বাড়ন্ত বয়সে আমিষ জাতীয় তিলের খৈল, শুটকি মাছের গুড়া ইত্যাদি চালের কুড়া সহ অন্যান্য খাদ্য উপাদান পরিমাণ মত মিশিয়ে খাওয়ালে দ্রুত বেড়ে উঠবে। খামারী ভাইদের একটা কথা মনে রাখতে হবে রাজহাঁসের দৈহিক ওজন মাত্র ১০-১২ সপ্তাহ বয়সেই ৩-৪ কেজি হয়ে থাকে । সুতরাং এ সময় রাজহাঁস পালনে খুবই মনযোগী হবে হবে । এভাবে একজন খামারী এক বছরে একজোড়া রাজহাঁস থেকে প্রায় ৪,০০০-৪,৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে ।

সংশ্লিষ্ট এলাকায় সরকারী প্রাণিসম্পদ অফিস বা সরকারী হাঁস-মুরগি খামারে কৃত্রিমভাবে ইনকিউবেটরে রাজহাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে খামারীদের কাছে বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে । এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য খামারী ভাইরা বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা এর পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগে যোগাযোগ করতে পারেন । ‘ড. মোঃ সাজেদুল করিম সরকার’