জীবাণুমুক্ত নিরাপদ ব্রয়লার উৎপাদনে ৫ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

472

জীবাণুমুক্ত নিরাপদ ব্রয়লার উৎপাদন পদ্ধতি

বাংলাদেশে ব্রয়লারসহ গোমাংস ও অন্যান্য মাংস উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মেধা ও শারীরিক গঠনের জন্য দৈনিক ১২০ গ্রাম প্রাণিজ আমিষ ভক্ষণ খাওয়া প্রয়োজন। বাজারে অনেক মাংস উপস্থিত থাকলেও শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ মাংস সন্ধান করেন। কারণ সবাই সুস্থ-সবল ও দীর্ঘজীবী হতে চান। একটি সুস্থ-সবল, মেধাবী জাতি ছাড়া শিক্ষা ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।

ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই পোলট্রি মাংস গ্রহণযোগ্য। উচ্চমাত্রার কোলস্টেরলের কারণে গো-মাংস কম গ্রহণ করে। ব্রয়লার সহজলভ্য ও সবত্রই পাওয়া যায়, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণও সহজ। আগামীতে পোল্ট্রি মাংসই প্রোটিনের চাহিদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

পশুপাখির রোগের কারণে ভবিষ্যতে মাংস গ্রহণ কম হবে বলে প্রতীয়মান হয়। আগামীতে মাংস উৎপাদনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হবে জুনোটিক রোগসমূহ যেমন- এভিয়ান ফ্লু, ম্যাড-কাউ, ক্ষুরারোগ, তড়কা ইত্যাদি। এছাড়াও অপ্রত্যাশিত কারণ যেমনÑ মাংসে ডাইঅক্সিন অথবা এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতির কারণে মাংস গ্রহণ হ্রাস পেয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখের মতো ছোট বড় মুরগির খামার রয়েছে। এসব খামারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান কেমন তা মূল্যায়ন করার সময় এসে গেছে। পরিকল্পনা ছাড়া যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে পোলট্র্রি খামার। প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। মানসম্মত বাচ্চার অভাব, বাসস্থান স্বাস্থ্যসম্মত নয়, ত্রুটিপূর্ণ রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সঠিক জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই ফলে ব্রয়লার মুরগির ওজন বৃদ্ধি হয় না এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এতে করে চাষিরা বাধ্য হয়ে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন।

এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা প্রদানের ফলে রোগ জীবাণু ও এন্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ মুরগির শরীরে থেকে যায়, যা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে আসে। ব্রয়লার উৎপাদনে খামারিরা পালন ব্যবস্থাপনায় নিম্নে বর্ণিত ৫+৫= ১০টি বিষয় মেনে চললেই নিরাপদ মাংস উৎপাদন সম্ভব হবে।

জীবাণুমুক্ত নিরাপদ ব্রয়লার উৎপাদনে ৫ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

১. মুরগির খামারকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে সুরক্ষা করা। খামারের চতুর্দিকে ২ মিটার দূর দিয়ে বেষ্টনী/ বেড়া দিতে হবে। এই বেষ্টনীকে পেরিমিটার ফেন্সিং বলে। বেষ্টনী নির্মাণ করলে অবাঞ্ছিত পশুপাখি খামারের আশপাশে আসতে পারবে না। অবাঞ্ছিত পাখি রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। পৃথকীকরণ না থাকলে খামারে রোগব্যাধি লেগেই থাকে, যে কারণে ওষুধ খরচ বেড়ে যায় এবং মুরগির ওজন আশানুরূপ হয় না। খামারে কোনো যানবাহন প্রবেশের পূর্বে চাকা পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। খামারে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত পোশাক, জুতা, গ্লভস এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। খামারের প্রবেশ মুখে ফুটবাথ থাকতে হবে এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। খামারে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত সাইনবোর্ড ব্যবহার করতে হবে।

২. নিরাপদ উৎপাদন উপকরণ ব্যবহার করা। নির্ভরযোগ্য উৎস এবং লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলার থেকে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধ ও ভিটামিন সংগ্রহ করতে হবে। বাচ্চা গ্রহণের সময় গড় ওজন দেখতে হবে। সব বাচ্চা একই গ্রেডের, আকৃতির আছে কিনা? খাদ্য ক্রয়ের সময় বস্তার গায়ে পুষ্টিমানের বিবরণ দেখে নিতে হবে।

৩. উত্তম খামার ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম অনুসরণ করা। রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় টিকা দিতে হবে। অল-ইন-অলআউট পদ্ধতি অনুসরণ করা। ধারণক্ষমতার বেশি মুরগির বাচ্চা উঠানো যাবে না। অসুস্থ মুরগি আলাদা রাখতে হবে। মৃত মুরগি যেখানে সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে।

৪. উত্তম ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন করা। খামারে কাজ করার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। পায়খানা করার পরও সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। খামারে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি যেমন-গামবুট, গ্লভস, মাক্স ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। যেসব কর্মী অসুস্থ অথবা হাতে কাটা, ক্ষত, ঘা রয়েছে তাদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না। উত্তম স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনে মানুষ থেকে মুরগিতে বা মুরগি থেকে মানুষে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে না।

৫. উত্তম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পালন করা। মৃত মুরগি যেখানে সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রতিদিন খামারের বর্জ্য পরিষ্কার করতে হবে। খামারের পাশে ময়লা জমিয়ে রাখা যাবে না। খামার আবর্জনা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। ইঁদুর দমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। খামারের পানি নিষ্কাশনের জন্য ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকতে হবে। পোলট্রি লিটার বা বিষ্ঠা দিয়ে জৈবসার তৈরি করে খামার বর্জ্য সম্পদে পরিণত করা দরকার।

রাসায়নিক দূষণমুক্ত নিরাপদ ব্রয়লার উৎপাদনে ৫ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
১. ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত মানসম্পন্ন খাদ্য ক্রয় করা। নির্ভরযোগ্য উৎস এবং লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলার থেকে মুরগির খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক খাদ্যে আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য গবেষণাগারে খাদ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন। রাসায়নিক দ্রব্য মুরগির মাংস ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জমা থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

২. ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত মানসম্পন্ন ভিটামিন ও মিনারেল ক্রয় করা। নির্ভরযোগ্য উৎস ও লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলার থেকে ভিটামিন, মিনারেলও ওষুধ সংগ্রহ করতে হবে। ওষুধের মেয়াদ দেখে নিতে হবে। প্রাণি চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত। নি¤œমানের ভিটামিন-মিনারেল ব্যবহার করলে মুরগির ওজন হ্রাসসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। রাসায়নিক দ্রব্য মুরগির মাংস ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জমা থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

৩. ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত নিরাপদ ও পরিষ্কার পানি ব্যবহার করা। পানিতে রাসায়নিক দ্রব্য যেমন-আর্সেনিক, আয়রন ধাতুর উপস্থিতি ক্ষতিকর। তাই বছরে একবার পানি পরীক্ষা করা দরকার। প্রতি মাসে দুইবার ব্লিচিং পাউডার দ্বারা পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে হবে। পানি কীটনাশক দ্বারাও দূষিত হতে পারে।

৪. প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না। অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ব্যবহার এড়াতে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা দরকার। সঠিক মাত্রা ও প্রত্যাহার সময়সীমা মেনে চললে মুরগির মাংসে এন্টিবায়োটিক এবং রেসিডিও সহনশীল মাত্রায় কমে আসে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিমুক্ত। উত্তম ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি এর বিকল্প হিসেবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না।

৫. খাদ্য, ওষুধ ও পানিকে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা দূষিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। খামারের বাইরে আলাদা জায়গায় খাদ্য ও ওষুধ মজুদের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বিরূপ আবহাওয়া, রাসায়নিক (যেমন- লুব্রিকেন্ট বা কীটনাশক) এবং পরিবেশগত দূষণ থেকে সুরক্ষা করা যায়। ফিডার ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

সর্বোপরি পোলট্রি ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা উন্নয়ন করতে হবে। আমরা যদি মানসম্মত পোলট্রি উৎপাদন করতে পারি তাহলে পোশাক শিল্পের মতো পোলট্রি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

সূত্র: আজকের কৃষি

ফার্মসএন্ডফার্মার/৩১আগস্ট২০