বীজের পর মাটি হচ্ছে কৃষির অন্যতম ভিত্তি। উপযুক্ত মাটি না হলে অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে কাক্সিক্ষত ফসল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় আবাদি জমির পরিমাণ খুবই কম। তাই এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল আবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এজন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক তা হলো-
১. ভূমি ক্ষয় রোধ
মাটির উপরিভাগ সাধারণত ৭”-৮” ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত ফসলের পুষ্টি উপাদান থাকে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, পানি প্রবাহ, বাতাসের গতিরোধ ইত্যাদি কারণে উপরিভাগের মাটি স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে সঞ্চিত পুষ্টি উপাদান বিনষ্ট হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই বৃষ্টি ও বন্যার পানি গড়ানের সময় যাতে জমির উপরিভাগের মাটি অপসারিত না হয় এবং নালা ও খাদের সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
২. সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ
ফসল পুষ্টির জন্য মাটি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান গ্রহণ করে বিধায় বিভিন্ন ফসল আবাদের ফলে মাটির উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। বিভিন্ন ফসল মাটি থেকে বিভিন্ন পরিমাণে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। তাই ঘাটতি পূরণের জন্য জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা উচিত।
৩. জৈব পদার্থ ব্যবহার
মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য জৈব পদার্থের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি উদ্ভিদের খাদ্যোপাদান সরবরাহ, মাটির অম্ল ও ক্ষারত্বের তারতম্য রক্ষা এবং রাসায়নিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। তাই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ গোবর সার, কম্পোস্ট, খামারজাত সার ইত্যাদি প্রয়োগ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা নেয়া উচিত। সবুজ সার ও বিভিন্ন ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশিয়ে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আদর্শ মাটিতে কমপক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুবই কম। সুতরাং যত বেশি পারা যায় জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
৪. উপযুক্ত শস্য বিন্যাস অনুসরণ
জমিতে প্রতি বছর একই ফসল বা একই ধরনের ফসলের চাষ করলে একটি নির্দিষ্ট স্তরের নির্দিষ্ট পুষ্টি, উপাদান নিঃশোষিত হয়ে উর্বরতা বিনষ্ট হয়। তাই পর্যায়ক্রমে গুচ্ছমূল জাতীয় ফসলের পর প্রধান মূলজাতীয় ফসল, একবীজপত্রীর পর দ্বিবীজপত্রীর ফসল এবং অধিক খাদ্য গ্রহণকারীর পর অল্প খাদ্য গ্রহণকারী ফসল আবাদ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। মাটি, প্রভৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে উপযুক্ত শস্য বিন্যাস অনুসরণ করতে হবে।
৫. ডালজাতীয় ফসলের চাষ
বিভিন্ন ধরনের ফসল মাটি থেকে অধিক পরিমাণ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। ফলে মাটি দ্রুত এর অভাব দেখা দেয়। জমিতে মাঝে মধ্যে ডাল জাতীয় ফসলের চাষ করে এ ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করা যায়। কারণ এগুলো শিকড়ের শুঁটিতে রাইজোবিয়াম নামক ব্যাকটোরিয়া বসবাস করে এবং বায়ু থেকে নাইট্রোজেন আহরণপূর্বক গুটিতে সঞ্চয় করে ও পরিণামে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
৬. জমিকে বিশ্রাম দেয়া
দীর্ঘদিন ধরে কোনোরূপ বিশ্রাম ছাড়া নিবিড় চাষাবাদ করা হলে মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈব গুণাবলির অবনতি ঘটে। তাই কয়েক বছর পর অন্তত এক মৌসুমের জন্য জমি পতিত রেখে বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য এ সময়ে জমিতে সবুজ সারের চাষ বা নিয়মিত পশু চারণের ব্যবস্থা করলে ভূমির উর্বরতা আরও বৃদ্ধি পায়।
৭. মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ
মাটির অম্লত্ব ও ক্ষরত্ব অতিরিক্ত বেড়ে গেলে উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ওই অবস্থায় অনেক খাদ্যোপাদানে ফসলের গ্রহণ উপযোগী হয় না। তাই প্রয়োজনে জৈবসার প্রয়োগে অম্লত্ব ক্ষারত্ব কমাতে হবে।
৮. চাষাবাদ পদ্ধতির উন্নয়ন
ত্রুটিপূর্ণ চাষাবাদ পদ্ধতি মাটির উর্বরতা বিনষ্ট করে। কিন্তু উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে ভূমির উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা সম্ভব। জমি সব সময় একই গভীরতায় কর্ষণ করলে ওই গভীরতার নিচে একটা শক্ত স্তরের সৃষ্টি হয় এবং ওই স্তরের নিচ থেকে খাদ্যোপাদান আহরণ করতে পারে না। তাই ভূমি কর্ষণের গভীরতা ও অন্যান্য আবাদ প্রক্রিয়া মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক।
৯. সুষ্ঠু পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা
সুষ্ঠু সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে মাঠের উর্বরতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই জমিতে পরিমিত সেচ দেয়া ও অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন।
১০. ক্ষতিকারক রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
মাটিতে অনেক সময় ক্ষতিকর রোগ ও কীটের জীবাণু বা ডিম থাকে এবং ফসল উৎপাদনকালে সেগুলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পর্যায়ক্রমে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে জমি চাষ করলে এবং মাটি রোদে শুকিয়ে নিলে সেগুলো বিনষ্ট হয়ে যায় এবং মাটির উন্নয়ন সাধিত হয়। প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সঠিক কৌশলে উপযুক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
১১. আগাছা দমন
আগাছা মাটি থেকে খাবার গ্রহণপূর্বক ভূমির উর্বরতা খর্ব করে ও শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। তাই জমিতে কখনও আগাছা জন্মিতে না দেয়া ও সর্বদা পরিষ্কার রাখা আবশ্যক।
১২. মৃত্তিকা জীবাণু সংরক্ষণ
মাটিতে অসংখ্য হিতকর জীবাণু থাকে এবং এরা ফসফরাস, লৌহ প্রভৃতি অদ্রবণীয় পদার্থসমূহকে পানিতে দ্রবণীয় পদার্থে রূপান্তর ও বায়ু থেকে মাটিতে নাইট্রোজেন সংযুক্ত করে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই মাটিকে এমনভাবে পরিচর্যা করা দরকার যেন মৃত্তিকা জীবাণুসমূহের বসবাসের পরিবেশ সমুন্নত থাকে।
১৩. পাক মাটি ও বোঁদ মাটি ব্যবহার
সাধারণত বৃষ্টিপাত ও বন্যার পানির সাথে মাটির উপরিভাগের পুষ্টি উপাদান ও জৈব পদার্থ অপসারিত হয়ে পথিমধ্যে পুকুর, ডোবা, নালা প্রভৃতির তলদেশে জমা হয়। এভাবে জমাকৃত মাটিকে পাক মাটি বা বোঁদ মাটি বলে এবং এটা খুবই উর্বর হয়। শুষ্ক মৌসুমে ওই মাটি কেটে আবাদি জমিতে মিশিয়ে দিলে মাটির উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাই ফসল আবাদের লক্ষ্যে উপরিউক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক:
অরুণ কুমার বিশ্বাস
অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা, ৫১, পশ্চিম টুটপাড়া মেইন রোড, খুলনা-৯১০০
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৪এপ্রিল২০