লতা জাতীয় গাছ হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত হচ্ছে পান। বহু প্রাচীন কাল থেকেই এই পানের ব্যাবহার আমাদের এই উপমহাদেশে রয়েছে। পানের ইংরেজি নাম Betel leaf / Betel Vine এবং বৈজ্ঞানিক নাম Piper betel. পান মূলত পাতা খাওয়ার জন্য চাষ করা হয়। এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। পানের রস হজমে সহায়তা করে, রুচি বৃদ্ধি করে এবং মুখের দুর্গন্ধ নাশক হিসাবে কাজ করে। বিজ্ঞানীদের ধারনা যে পানের আদি জন্মস্থান মালয়েশিয়ার স্যাঁতসেঁতে স্থানে। বাংলাদেশের খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও রাজশাহী জেলায় ব্যাপকভাবে পানের চাষ হয়। তবে অন্যান্য জেলায়ও পানের চাষ বিস্তার লাভ করছে।
পানের জাতঃ সাধারণত নানা জাতের পান দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে ঢলপান বা বাংলাপান, মিঠাপান, ছাঁচিপান, লালিপান, কর্পূরীপান, গাছপান ইত্যাদি।
জলবায়ু ও মাটিঃ ছায়াচ্ছন্ন গ্রীষ্মপ্রধান স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে পান ভালো জন্মে। গ্রীষ্মকালে পানের আকার ছোট হয় তবে স্বাদ ভালো হয়। বর্ষাকালেও পানের ফলন ভালো হয়। তবে অধিক বৃষ্টিপাত ও গাছের গোড়ায় পানি দাড়ানো পানের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গের জেলাগুলোতে কৃত্রিম পরিবেশের মাধ্যমে পান চাষের বিস্তার হচ্ছে। সাধারণত চারদিকে এবং উপরে নিখুঁতভাবে গাছ-গাছড়া অথবা পাটকাঠি ইত্যাদির দ্বারা ঘিরিয়ে ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। চারিদিকে ছায়াঘেরা এ মনোরম পরিবেশকে চলতি ভাষায় ‘বর’ বা ‘বারোজ’ বলা হয়। বারোজগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন গাছের জন্য প্রয়োজনীয় আলো বাতাসে বিঘ্ন না ঘটে।
জৈব সারে সমৃদ্ধ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে এমন বেলে দোআঁশ, দোআঁশ ও এটেল মাটি পান চাষের উপযোগী। লাল দোআঁশ মাটিতেও প্রয়োজন মতো জৈব সার ও পলি মাটি মিশিয়ে চাষ করা যেতে পারে। পাহাড়ি এলাকায় মাটির গর্ত করে পানের চারা লাগানো হয়। গর্তগুলো ২৫/৩০ সেমি গভীর ও ৩০ সেমি চওড়া করা হয়। প্রতি গর্তে ৪০০-৮০০ গ্রাম পর্যন্ত কাঠের ছাই গোবর সার ও কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা হয়।
চারা প্রস্তুকরণঃ পান গাছের কান্ডকে ছোট ছোট টুকরায় কেটে চারা তৈরি করতে হয়। প্রতিটি চারা লম্বায় ২৫-৩০ সেমি এবং তাতে ৩-৫টি গাঁইট (পর্ব) থাকা আবশ্যক। সাধারণত দুটি গাইট মাটির নিচে এবং একটি বা অধিক গাঁইট মাটির উপরে রাখা হয়। চারা প্রস্তুতের জন্য কমপক্ষে দুই বছর বয়সের পুরাতন এবং সুস্থ ও নীরোগ গাছ নির্বাচন করা হয়।
চারা রোপণ ও রোপণের দূরত্বঃ বর্ষা শুরুর ঠিক পরেই পানের চারা রোপণ করার উপযুক্ত সময়। চারা রোপণের পূর্বে দরকার হলে জমিতে সেচ দেওয়া আবশ্যক। যে সকল অঞ্চলে ‘ঢলে পড়া’ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি, সে সকল অঞ্চলে প্রতিষেধক হিসেবে সেচের পানির সাথে কপার সালফেট মিশিয়ে দিলে সুফল পাওয়া যায়।
পানের চারা রোপণের সময় এক চারা হতে অপর চারার দূরত্ব ২৫/৩০ সেমি রাখতে হয়। এছাড়া সারি হতে সারির দূরত্ব ৩৫/৪৫ সেমি রাখা দরকার। ২/৩ সপ্তাহের মধ্যেই পানের চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং ১ মাসের মধ্যে প্রথম পাতা দেখা যায়। পানের চারা একটু বড় হলেই তাকে খাড়াভাবে বর্ধিত হওয়ার জন্যে অবলম্বন দরকার এবং সেহেতু পাটকাঠি বা বাঁশের কঞ্চি পুঁতে তার সাথে পান গাছ বেধে দিতে হয়।
পানের পরিচর্যাঃ পানের ক্ষেতে যাতে আগাছা না জন্মে সেদিকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়। সাধারণত পান গাছকে ১-১.৫ মিটারের বেশি লম্বা হতে দেওয়া হয় না। কারণ অতিরিক্ত লম্বা গাছ হতে পান সংগ্রহ করা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এবং সে সঙ্গে গাছের জীবনী শক্তিও কমে যায়। সেজন্যে বেশি উঁচু হলে গাছকে মাঝে মাঝে অবনমন প্রক্রিয়ায় সতেজীকরণ করা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ উঁচু হওয়ার পর গাছকে আর অবলম্বনের সাথে বাঁধার দরকার হয় না। তখন গাছের ডগাগুলো লতিয়ে নিচের দিকে অবশেষে জমিতে নেমে আসে। এ অবস্থায় গাছের বর্ধনশীল অংশ বাইরে রেখে ভূমি সংলগ্ন অংশটি মাটি চাপা দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় গাছকে সতেজীকরণ করা হয় এবং এটি বছরে কমপক্ষে একবার করতে হয়। বর্ষাকালে সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে শীত মৌসুমে ৬/৭ দিন পর পর একবার সেচ দিতে হয়।
সার প্রয়োগঃ পানের জমিতে প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ৩০-৫০ কুইন্টাল গোবর সার প্রয়োগ করতে হয়। চারা ৫/৬ পাতাওয়ালা হলেই পচা খৈল জাতীয় সার প্রয়োগ করলে গাছ সতেজ হয়ে ওঠে। হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া ৩ বারে জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। উক্ত সারের সাথে ৫০ কেজি টিএসপি ও ৫০ কেজি পটাশ সার মিশ্রিত করে প্রয়োগ করতে হয়। উক্ত সার ৩ বারে সারির উভয় পার্শ্বে ২-১ ইঞ্চি গভীরতায় প্রয়োগ করতে হয়।
পোকামাকড় ও রোগঃ যে সমস্ত পোকামাকড় পান বারোজের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে তাদের মধ্যে বিটেল ডাইন বাগ, মিলিবাগ, অ্যাফিড ও মাইট বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মিলিবাগ পূর্ণাঙ্গ ও নিমফ (nymph) অবস্থায় পাতার রস চুষে পানের ক্ষতি করে। অনুমোদিত কীটনাশক মাত্রানুযায়ী প্রয়োগ করলে এ সকল পোকামাকড় দমন করা যায়।
পানের রোগ পান চাষিদের নিকট সবচেয়ে বড় সমস্যা। পান বারোজে রোগের প্রাদুর্ভাব হলে যেমন উৎপাদন কমে যায় তেমনি পানের বাজার দরও হ্রাস পায়। পানের রোগের মধ্যে গোড়া পচা রোগ, ঢলে পড়া রোগ, ছাতা ধরা রোগ ও পাতার দাগ ধরা রোগ বেশি মারাত্মক। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক মাত্রানুযায়ী প্রয়োগ করলে এ সকল রোগ দমন করা যায়।
সাথী ফসলঃ পানের সাথে অতিরিক্ত সাথী ফসল হিসেবে পান বরোজেরই পাশে লাউ, কুমড়া, করল্লা, পটল, ডাঁটা ইত্যাদির চাষও বেশ লাভজনক। এ চাষে পানের ক্ষেতে ছায়া সৃষ্টি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের উপরি রোজগারেরও সুযোগ হয়।
পান তোলাঃ সঠিকভাবে যত্ন ও পরিচর্যা করলে চারা লাগানোর ছয় মাস পর হতে পান তোলা যেতে পারে। স্থান বিশেষে পান তোলার জন্য বাগিচা তৈরি হতে সময় লাগে এক বছর হতে তিন বছর। প্রতিটি গাছ হতে বছরে তিন/চার এমনকি পাঁচবারও পান তোলা যায়।
ফলনঃ বাংলাদেশে গড়ে হেক্টর প্রতি ৩০-৩৫ মিলিয়ন পান জন্মে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০২মে২০