জেনে নিন গমের ৬টি রোগ ও তার প্রতিকার

337

বাংলাদেশে খাদ্য ফসল হিসাবে গম দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে । খাদ্যমানের দিক থেকে গম চালের চেয়ে পুষ্টিকর। চালের তুলনায় গমে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের পরিমান বেশী। অপরদিকে গম চাষে পানির প্রয়োজন ধানের তুলনায় খুবই কম।
যে জমিতে সেচের সুবিধা নেই অথচ মাটিতে যথেষ্ট পরিমানে রস থাকে সে জমিতে বিনাসেচেও সফলভাবে গম চাষ করা যায়। কিন্তু গমের রোগবালাই গম চাষের একটি অন্যতম প্রতিবন্ধক। এব ফলে গমের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন হয়।

১। রোগের নাম : গোড়া পঁচা রোগ
রোগের কারণ : স্কেরোসিয়াম, রাইজোকটোনিয়া, ফিউজারিয়াম ইত্যাদি ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার : মাটিতে ও বীজে বসবাসকারী ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগের উৎপত্তি হয়। স্যাঁতস্যাঁতে মাটি ও ঠান্ডা আবহাওয়া এ রোগ বিস্তারে সহায়ক।

রোগের লক্ষণ :
-এ রোগের ফলে বীজে পচন ধরে, চারা ঝলসে যায় এবং গোড়া ও শিকড় পঁচে যায়।
-চারা গজানোর পর গাছ আক্রান্ত হলে প্রথমে গাছটি হলুদ বর্ন ধারন করে এবং আস্তে আস্তে গাছটি মারা যায়।
-এ অবস্থায় টান দিলে গাছটি সহজেই মাটি হতে উঠে আসে।
-আক্রান্ত গাছটির গোড়া ভালভাবে পরীক্ষা করলে গোড়ায় সাদা বর্ণের ছত্রাকের মাইসিলিয়াম এবং অনেক সময় সরিষার দানার মত স্কেরোসিয়া দেখা যায়।
-এ সময় সমস্ত শিকড় পচে যায়, শিকড় ও কান্ড সংলগ্ন অংশে কালচে বাদামী দাগ দেখতে পাওয়া যায়

রোগের প্রতিকার :
-সুস্থ, সবল ও উচ্চ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ বপন করতে হবে।
-কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।

-উচ্চ তাপমাত্রা ও বৃষ্টিহীন মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল) জমি ভালভাবে চাষ দিয়ে ফেলে রাখতে হবে।
-জমিতে রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।

২। রোগের নাম : গমের ব্লাস্ট রোগ
রোগের কারণ : ম্যাগনেপরথে অরাইজি প্যাথোটাইপ ট্রিটিকাম নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার:
আক্রান্ত বীজের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক গরম ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া থাকলে এ রোগের আক্রমন ঘটতে পারে। বৃষ্টির কারণে গমের শীষ ১২-২৪ ঘন্টা ভেজা থাকলে ও তাপমাত্রা ১৮ সেঃ অথবা এর অধিক হলে এ রোগের সংক্রমণ হয় এবং রোগের জীবাণু দ্রুত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

রোগের লক্ষণ
-প্রধানত: গমের শীষে ছত্রাকের আক্রমণ হয়।
-পাতায় চোখের ন্যায় ধূসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে।
-শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে।
-আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়।
-শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়।
-আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় ও কুঁচকে যায় এবং দানা ধুসর বর্ণের হয়।
-পাতায়ও এ রোগের আক্রমন হতে পারে এবং এক্ষেত্রে পাতায় চোখের মত ধূসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে।

রোগের প্রতিকার
-ব্লাস্ট মুক্ত ক্ষেত থেকে গম বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
-মাড়াইয়ের পর আক্রান্ত গম ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
-অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল জাত যেমনঃ বারি গম ২৮ ও বারি গম ৩০ জাতের চাষ করতে হবে।
-উপযুক্ত সময়ে (অগ্রহায়ণের ০১ হতে ১৫ তারিখ) বীজ বপন করতে হবে যাতে শীষ বের হওয়ার সময়ে বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা পরিহার করা যায়।
-বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের সাথে ৩ গ্রাম প্রোভ্যাক্স-২০০ ডব্লিউপি অথবা ৩ মিলি হারে ভিটাফ্লো-২০০ এফএফ ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করলে গমের ব্লাস্ট রোগের পাশাপাশি অন্যান্য বীজবাহিত রোগও দমন হবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে।
-গমের ক্ষেত ও আইল আগাছামুক্ত রাখুন।
-নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি/নভিটা ৭৫ ডব্লিউজি প্রতি লিটার পানিতে ০.৬ গ্রাম হারে মিশিয়ে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং তার ১২-১৫ দিন পর আরেকবার স্প্রে করলে গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ রোগ এবং মরিচা রোগ ইত্যাদিও দমন হবে।

৩।রোগের নাম : পাতা ঝলসানো রোগ

রোগের কারণ
বাইপোলারিস সরোকিনিয়ানা নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
রোগটি প্রধানত বীজ বাহিত, তবে মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশে ছত্রাকটি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। বীজ বা মাটিবাহিত জীবানুর মাধ্যমে প্রাথমিক আক্রমনের পর রোগটি বাতাসের সাহায্যে বয়স্ক পাতা থেকে নতুন পাতা এবং এক গাছ থেকে অন্য সব গাছই রোগক্রান্ত হয়। পাতা ঝলসানো রোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বাতাসের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি এবং নাবীতে বীজ বপন।

রোগের লক্ষণ
-এ রোগের প্রাথমিক আক্রমন চারা অবস্থাতেই শিকড় বা পাতায় ঘটে থাকে।
-শিকড় আক্রান্ত হলে গাছ চারা অবস্থাতেই হলুদ হয়ে মারা যায় যা চারা ঝলাসানো রোগ নামে পরিচিত।
-গাছ মাটির উপর আসলে প্রথমে নীচের পাতাতে ছোট ছোট বাদামী রঙের ডিম্বাকৃতি দাগ পড়ে।
-দাগগুলার চারপাশ দিয়ে একটি হলুদ আবরণ দেখা যায়।
-পরবর্তীতে দাগগুলো ক্রমশ: বড় হতে থাকে এবং দাগের মধ্যস্থল ধূসর বর্ণ ধারণ করে।
-গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দাগগুলো একত্রিত হতে থাকে এবং রোগটি নীচের পাতা থেকে উপরের পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
-এ কারণে পাতা আগাম শুকিয়ে যায় যা দূর থেকে আগুনে পোড়া বা ঝলসানো বলে মনে হয়।
-রোগের অনুকুল আবহাওয়ায় গমের শীষও আক্রান্ত হয় এবং বীজে রোগের সংক্রমন ঘটে।
-আক্রান্ত বীজে কালো দাগ পড়ে এবং বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়।

রোগের প্রতিকার
-রোগমুক্ত জমি হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
-গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলতে হবে।
-পরিমিত মাত্রায় সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
-কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
-রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে অথবা টেবুকোনাজল (ফলিকুর ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

৪।রোগের নাম : বীজে কালো দাগ রোগ
রোগের কারণ
বাইপোলারিস সরোকিনিয়ানা নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
গম পরিপক্কতার সময় যদি বৃষ্টি হয় অথবা বাতাসে জলীয় বাষ্প অধিক থাকে তবে এ রোগের আক্রমণ অধিক হয়ে থাকে। রোগাক্রান্ত বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমে যায় এবং অনেক সময় খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

রোগের লক্ষণ
-এ রোগের সনাক্তকারী প্রধান লক্ষণ হল বীজের ভ্রুণে কালো দাগ পড়ে।
-এ দাগ ছত্রাক দ্বারা ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে র্সষ্টি হয়।

রোগের প্রতিকার
-বৃষ্টি শুরুর আগেই ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
-গম পরিপক্কতার পর জমিতে সেচ প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে।
-রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

৫।রোগের নাম : পাতার মরিচা রোগ

রোগের কারণ
পাকসিনিয়া রেকোনডিটা নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
এ রোগ ফসলের পরিত্যক্ত অংশ ও বিকল্প পোষক গাছ হতে বাতাসের মাধ্যমে সুস্থ গাছে ছড়ায়। সাধারণত কম তাপমাত্রা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া রোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক।

রোগের লক্ষণ
-প্রথমে পাতার উপর ছোট ছোট গোলাকৃতি কমলা রংগের দাগ পড়ে। ।
-ক্রমে এসব দাগের আকার বড় হতে থাকে, সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বাদামী রং ধারণ করে।
-এ অবস্থায় গায়ে লাগলে বা হাত দিয়ে স্পর্শ করলে মরিচার মত দাগ লেগে যায়। এ সমস্ত দাগগুলো হলো রোগের জীবাণুর অসংখ্য স্পোর।
-আক্রমণ বেশি হলে এগুলো কান্ড ও খোলে দেখা যায়।
-পরিপক্ক অবস্থায় দাগগুলো কাল বর্ণ ধারণ করে, যা হল রোগের টিলিয়াল স্টেজ।
-আক্রমণ ব্যাপক হলে পাতাগুলো দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং জমি পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়।
-এ রোগের লক্ষণ প্রথমে নীচের পাতায়, তারপর সব পাতায় ও কান্ডে দেখা যায়।

রোগের প্রতিকার
-ফসল সংগ্রহের পর ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পৃড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা মাটিতে পুতে রাখতে হবে।
-রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে।
-কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
-সুষম সার প্রয়োগ, সেচ ও জমির আগাছা দমন করতে হবে।
-আগাম চাষ অর্থাৎ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বীজ বপন করলে রোগের মাত্রা কম হবে।
-রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে অথবা টেবুকোনাজল (ফলিকুর ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

৬।রোগের নাম : আলগা ঝুল রোগ (Loose smut)

রোগের কারণ
উস্টিল্যাগো ট্রিট্রিসি নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
এ রোগটি বীজ বাহিত। সুস্থ জমিতে এটি বীজ ও বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। ঠান্ডা ও অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চলে লুজ স্মাট রোগ বেশী হয়।
রোগের লক্ষণ
-গমের শীষ আসার সময় দেখা যায় যে, গমের শীষে ফুল ও বীজের পরিবর্তে সমস্ত শীষ কাল রঙের পাউডার দ্বারা ভর্তি থাকে যা দেখতে ঝুলের ন্যায় দেখায়।
-এ সমস্ত পাউডার ছত্রাকের অসংখ্য কাল রঙের অণুজীব বা স্পোর।
-প্রথম দিকে ছত্রাক স্পোর একটি পাতলা আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে। পরে ওই পাতলা আবরণ ফেটে স্পোরগুলো বের হয়ে যায়।
-ফলে আক্রান্ত গাছের ছড়াটি দানাশুন্য অবস্থায় থাকে।
-স্পোরগুলো পরবতীতে সুস্থ গাছকে আক্রমণ করে।

রোগের প্রতিকার
-সুস্থ জমি হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
-বীজ ৪ ঘন্টা ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরে ৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার পানিতে ১০ মিনিট রেখে শোধন করতে হবে।
-কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
-জমিতে রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে আক্রান্ত শীষ আস্তে পলিথিন অথবা চটের ব্যাগে ভরে জমি থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
-রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

লেখক: ডিপ্লোমা কৃষিবিদ-রুহুল আমিন

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৯ অক্টোবর ২০২১