দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। লকলক করে বেড়ে উঠছে গাছগুলো। সপ্নভূক কৃষকের মুখে প্রানজুড়ানো হাসি। সার, সেচ, নিড়ানী – যত্ন-আত্নীর কমতি নেই। গাছগুলোতে ফুল আসতে শুরু করেছে মাত্র। কদিন বাদেয় থোকা থোকা ফলে ভরে উঠবে ফসলের মাঠ। কিন্তু হঠাত দেখা যায়, জমিতে দু একটি করে গাছ মারা যাচ্ছে। দাগ, পচন বা অন্য কোন লক্ষন নেই। চাষীর কপালে চিন্তার ভাজ। শংকা বাসা বাধে মনে। তবুও আশাবাদী কৃষক মৃত গাছটি তুলে শুন্য জায়গায় নতুন একটি গাছ লাগিয়ে দেয়। নানাজনের পরামর্শে বাজারের যাবতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়না। কিছুদিনের মাঝেই সবুজ মাঠ বিরানভূমিতে পরিনত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ রোগটির প্রকোপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে কৃষকরা এ রোগটি দমনে করনীয় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। অনেকে গাছের নমুনা নিয়ে আসছেন। অনেক অঞ্চলে আক্রমনের মাত্রা ব্যাপক হওয়ায় কৃষকরা শংকিত হয়ে পড়েছেন।
টমেটো, বেগুন, আলুসহ অনেক সব্জী ফসলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ দেখা দেয়। এ রোগের আক্রমনে প্রথমে গাছের উপরের দিকের কিছু পাতা নেতিয়ে পড়ে, দু একদিনের মধ্যে পুরো গাছ ঢলে পড়ে ও মারা যায়। এ রোগে গাছের শিকড়, মূল, কান্ড বা অন্য কোথাও পচন দেখা দেয় না। সাধারনত গাছের বাড়ন্ত অবস্থায় যখন ফুল ফল আসতে শুরু করে তখন রোগের আক্রমন ব্যাপক হয়। আক্রান্ত গাছের কান্ড কেটে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তরল আঠালো পদার্থ (ব্যাক্টেরিয়া) বের হয়।
রালস্টোনিয়া নামক মাটিবাহিত ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমনে এই রোগ হয়। এটি একটি মাটিবাহিত রোগ, মানে রোগের জীবানু মাটিতে থাকে। সেচের পানির মাধ্যমে জীবানু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ও নতুন গাছে আক্রমন করে। সাধারনত ক্ষারীয় মাটিতে রোগের প্রোকোপ বেশী দেখা দেয়। মাটির তাপমাত্রা বেশী হলে রোগের আক্রমন বেশী হয়। জমিতে ইউরিয়া সার বেশি দিলে এবং এমপি ও টিএসপি সার কম দিলে রোগ বেশী হয়। মাটিতে নেমাটোড বা কৃমি থাকলে ঢলে পড়া রোগ বেশী হয়। কৃমি গাছের শিকড়ে ক্ষত (ইঞ্জুরি) করে, এই ক্ষতস্থান দিয়ে ব্যাক্টেরিয়া গাছের ভিতর প্রবেশ করে। জীবানু গাছের শিকড়ের ক্ষতস্থান দিয়ে গাছের কান্ডের (ভাস্কুলার বান্ডেল) ভিতর প্রবেশ করে। এবং কান্ডের ভিতর পানি চলাচলের রাস্তাকে (জাইলেম ভেসেল) ব্লক করে দেয়। অনেকটা মানুষের হার্টের ব্লকের মতো। ফলে পানি গাছের শিকড় থেকে উপরে যেতে পারেনা এবং গাছ ঢলে পড়ে বা নেতিয়ে পড়ে। দু একদিনের মাঝে গাছটি মারা যায়।
তিনটি কারনে এ রোগটি দমন বেশ কষ্টসাধ্য। প্রথমত রোগের জীবানু মাটিতে সুরক্ষিতভাবে থাকে। দ্বিতীয়ত, জীবাণু গাছের কান্ডের ভিতর থাকায় বালাইনাশকের সরাসরি সংস্পর্শে আসে না। তৃতীয়ত, বাজারে কার্যত খুব ভালোমানের ব্যাক্টেরিয়ানাশক নেই। তাই এই রোগ দমনে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ শ্রেয়।
সব্জী ফসলে এরোগের প্রতিরোধী জাত খুব কম। কিছু সহনশীল জাত রয়েছে। জমি চাষের সময় ব্লিচিং পাউডার ১৫-২০ কেজি/হেক্টর মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে মাটিতে বিদ্যমান ব্যাক্টেরিয়া মারা যায়। গাছের চারা লাগানোর আগে চারার গোড়ার অংশ কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক বা অনুমোদিত ব্যাক্টেরিয়ানাশকের দ্রবনে ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে লাগাতে হবে। জমিতে চারা লাগানোর আগে মাটিতে চারা লাগানোর স্থানে এক চিমটি ৫-১০ গ্রাম/ পিট ফুরাডান ৫ জি মিশিয়ে দিতে হবে। এতে মাটিতে বিদ্যমান কৃমি ও কাটুই পোকা মারা যাবে।
জমিতে রোগের আক্রমন দেখা দিলে প্লাবন সেচ দেয়া যাবে না, শুধুমাত্র গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। ইউরিয়া সার কম দিতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত স্থানের মাটি সরিয়ে ফেলে, নতুন মাটি দিয়ে নতুন করে গাছ লাগাতে হবে।
কপার জাতীয় ছত্রাকনাশকে ব্যাক্টেরিয়া প্রতিরোধী উপাদান রয়েছে। তাই কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের সালকক্স/ ব্লিটক্স/ সানভিট/ ডিলাইট/ হোসাকপ ছত্রাকনাশক ৭-৮ গ্রাম প্রতি কেজি পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে দিলে রোগ কমে আসে।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যাক্টেরিয়ানাশক বাজারে এসেছে। এগুলো হলো বিসমার্থিওজল গ্রুপের ব্যাকট্রোল/ ব্যাকট্রোবার্ন/ অটোব্যাক – যা ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও রয়েছে ইমিডাক্লোরোপিড+ থিরাম + কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের আটাভো/ নাজদা/ টপজিম; কাসুগামাইসিন গ্রুপের কাসুমিন / কায়সার; কোয়ার্ডারটারী এমোনিয়াম গ্রুপের টিমসেন – এগুলো অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়াও এন্টিবায়োটিক হিসেবে আছে, ভ্যালিডামাইসিন গ্রুপের ভ্যালিড/ সিনোপা/ নির্ভয় /সিনোম – ১.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা।
ট্রাই ব্যাসিক কপার সালফেট (কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি) ১ লিটার পানিতে ৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার জমিতে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। ব্যাকটেরিয়া নাশক স্ট্রেপ্টোমাইসিন সালফেট + টেট্রাসাইক্লিন হাইড্রোক্লোরাইড (ক্রোসিন-এজি ১০ এসপি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৮ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার জমিতে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। ক্রোসিন-এজি ১০ এসপি ও কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি ঔষধ দুইটি পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
এছাড়াও বাজারে বিদ্যমান স্ট্রেপ্টোমাইসিন সালফেট গ্রুপের ব্যাক্টেরিয়ানাশক ক্রোসিন/ আন্টিব্যাক/ ডাইব্যাক্টেরিয়া / বাহা – এগুলো ০.৫ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় ২-৩ বার প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। কপার গ্রুপের একটি ছত্রাকনাশক এবং যেকোন একটি ব্যাক্টেরিয়ানাশক পর্যায়ক্রমে ব্যাবহার করা ভালো। মনে রাখতে হবে, যেকোন ক্যামিকেলই বিষ; এগুলো অবশ্যয় অনুমোদিত মাত্রায় যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৯ফেব্রু২০