ঠাকুরগাঁওয়ে ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব

150

ঠাকুরগাঁওয়ে চলছে আগাম জাতের আমন ধান কাটা ও মাড়াই। শেষ মুহূর্তে আবহাওয়া ভালো ও পোকার আক্রমণ কম থাকায় আমনের আবাদ ভালো হয়েছে। কৃষকের মনে এসেছে আনন্দের জোয়ার। নতুন ধানে এসেছে নবান্ন, নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা। নতুন ধান ঘরে ওঠানোর কাজে ব্যস্ত আছে কিষান-কিষানিরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। গ্রামবাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় এক সামাজিক মেলবন্ধনের।

এরই ধারাবাহিকতায় ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামাঞ্চলে চলছে নানা উৎসব, নানা আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই সঙ্গে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব। বাঙালির ১২ মাসে ১৩ প্লাবনÑএ যেন সত্যি হƒদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। নতুন ফসল ঘরে ওঠার আনন্দ। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির জীবনে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক নানা রকম খাবার। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্ন ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায় উঠে এসেছে প্রকৃতির চিত্র।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এক লাখ ৩৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় চার লাখ ২৯ হাজার ৭১৬ মেট্রিক টন, যা গত বছরে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৩৭ হাজার ২৫ হেক্টর। এর মধ্যে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তিন লাখ ৯৭ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন। কৃষকরা এবার বিভিন্ন জাতের আমন ধান আবাদ করেছে, যেমন বিনা-৭, ধানীগোল, সুমন স্বর্ণ, গুটি স্বর্ণ ও বিভিন্ন জাতের চিকন ধান।

প্রতি বছর এ সময়টায় কৃষকের মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান এ সময়ে কিষান-কিষানিরা। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। তার পরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেয়ায় সৃষ্টি হয় আনন্দঘন পরিবেশ। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর, পায়েসসহ নানা ধরনের খাবার। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়াদাওয়ার ধুম।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুন কহরপাড়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মো. কামাল হোসেন জানান, আগাম জাতের আমন কেটে বিক্রির পর পিঠা তৈরির জন্য চালোর গুঁড়ো করা হচ্ছে ঘরে ঘরে। মেয়ে-জামাই ও আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীকে খাওয়ানো হবে নানা ধরনের পিঠা-পায়েস। খেজুরের রসও সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সদর উপজেলার আখানগর ইউনিয়নের ভেলারহাট গ্রামের কৃষক বদিরুল ইসলাম জানান, ক্ষেত থেকে আগাম জাতের আমন ধান বিনা-৭ কাটা হচ্ছে। সেগুলো ঘরে তোলার পর আলু ও শাকসবজি চাষ করব। এরপর নবান্ন উৎসব শুরু হবে।

উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য নবান্ন উৎসব। এই উৎসবকে ধরে রাখতে হবে। তবেই মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাতৃত্ব বজায় থাকবে। এসব লালন করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইএসডিও প্রতি বছর নবান্ন উৎসব ও পিঠা উৎসব পালন করে থাকে বলে জানান তিনি।