তখন আমি ক্লাশ এইটে পড়ি। আমার নানী আসছেন বাসায়। স্কুল সাময়িক পরীক্ষা চলছিল। দুপুরের পর পরীক্ষা। দুপুরের খাবার খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাবো। যতটুকু মনে মা সেদিন ডিম দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিলেন। খাওয়া কেবল শুরু করছিলাম অমনি হঠাৎ: আমার নানী এসে মা’কে বললেন, ‘কী করোস কী, আমার নাতিরে আন্ডা ডিম দিয়া ভাত খাইতে দিছোস ক্যান? পরীক্ষার দিতে যাওয়ার আগে পোলাপানরে ডিম খাওয়াইতে নাই।’
কথাটি যে, আগেও শুনিনি তা নয়। নানীর কথায় কেন জানি মনের ভেতর খটকা লাগলো। যদি সত্যিই পরীক্ষা খারাপ হয়ে যায়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়, ফার্মের মুরগির ডিম তেমনভাবে পরিচিত হয়েও উঠেনি সাধারণের কাছে তখন। মাছের চেয়ে মুরগি বা ডিম ছিল তুলনামূলক দামী খাবার। কী আর করা, নানীর কথা শুনে এক ধরনের খটকা লেগে গেল। সন্দেহ রোগ ভেতরে ঢুকলে যা হয় আর কী। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ডিমের বদলে বাটারবান খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম। অথচ ডিমের কোলিন (choline) ব্রেইন ও নার্ভের কার্যকলাপ সক্রিয় রাখে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে পুষ্টি যাতায়াত ব্যবস্থাকে তরান্বিত করতে বিশেষ ভ’মিকা পালন করে। ডিমে বিদ্যমান ফলিক এসিড গর্ভবতী মায়েদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা বাচ্চাদের নার্ভ সম্পর্কিত সমস্যা কাটাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে সেই বিষয়ে আমার তখন জানা ছিল না।
হয়তো অনেকে মনে মনে হাসছেন। কারণ, বাংলাদেশে এমন ছাত্র-ছাত্রীই পাওয়া যাবে কী না সন্দেহ আছে যাদের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ডিম খাওয়া নিয়ে এ ধরনের ঘটনা নাই। শিক্ষিত অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষের ভেতর যুগ যুগ ধরেই কিছু কুসংস্কার ছিল এবং আছে এখনো আমাদের মাঝে। এমনকি দেড় যুগ পরেও আজকের ডিজিটাল সময়ে এ রকম ধারনা রয়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। সমাজে কিছু কিছু মিথ্ বিশ্বাস কিংবা কুসংস্কার রয়েছে যা এখনো দাপটের সাথে বিদ্যমান। পরীক্ষা দেওয়ার আগে ডিম খাওয়া নিয়ে এমনই একটি মিথ বা কুসংস্কার যা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। যদিও ডিম খাওয়ার ফলেই পরীক্ষায় ফেইল করেছে এমন কোন চাক্ষুস, বৈজ্ঞানিক কিংবা ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ নিজেও পাইনি, কেউ পেয়েছেন বলেও শুনিনি।
ডিম নিয়ে সমাজে আরো অনেক ধরনের নেতিবাচক ধারনা রয়েছে। এমনকি শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মাঝেও ব্যাপারটি লক্ষণীয়। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে কিছুদিন আগেও একটি ভ্রান্ত ধারনা ভাইরাল হয়েছিল প্লাস্টিক বা নকল ডিম বিষয়ে। অনেক বড় বড় শিক্ষিত লোককেও দেখেছি বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে খোজ খবর না দিয়েই নেতিবাচক লেখালেখি করতে, অতি উৎসাহী হয়ে প্রচারনা চালাতে। এমনকি চোখ বুঝে শেয়ার করতে।
বছর পাঁচেক আগের কথা। হঠাৎ করে একদিন, দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠের পরিচয় দিয়ে এক ভদ্র মহিলা বেসরকারি এক চ্যানেলের সাংবাদিক, ক্যামেরা পার্সনসহ হাজির হলেন আমার পুরাতন কর্মস্থলে। তাঁর অভিযোগ বাজার থেকে তিনি যে ডিম কিনেছেন সেগুলো নাকি নকল এবং তারই প্রমান নিয়ে এসেছেন আমাদের কাছে। আমাদের অফিসের দু’জন নিউট্রনিস্ট এবং আমি বসলাম তাদের সাথে বিষয়টি জানা ও বোঝার জন্য। কারণ, ডিমের বিষয়গুলো এতটাই টেকনিক্যাল যে, আমারও ভালো করে জানা দরকার।
ভদ্রমহিলা খুব জোর দিয়ে বলেই চলেছেন যে, তার নিয়ে আসা ডিমগুলো নকল। রিপোর্টার সাহেবও মাথা নাড়ালেন। আমি বললাম, ডিমগুলো যদি সত্যি নকল হয় তবে সেটি সত্যিই উদ্বেগের। তবে নস্ট ডিম আর নকল ডিম এক জিনিস নয়। আমরা নস্ট ডিম বা বায়োলজিক্যাল ডিফেক্টেড ডিমকে নকল ডিম বলছিনাতো সেটিও দেখার বিষয় আছে।
ভদ্রমহিলা এবার রাগ রাগ ভাব নিয়ে জোর দিয়ে বললেন, ডিমগুলো নকল এবং আমাদের কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে। আমি উত্তর দিলাম, যদি তথ্য-প্রমাণ আপনাদের কাছে থেকেই থাকে চলেন আমরা সেই নকল ডিমের ফ্যাক্টরিতে যাবো। কারণ, দিনশেষে আমি নিজেও একজন ভোক্তা। কামাই করা টাকা দিয়ে আমি নিজেও ডিম কিনে খাই। রিপোর্টার সাহেবকে বললাম, কাজল ভাই (ছদ্মনাম) চলেন তাহলে ক্যামেরা নিয়ে আমিও যাবো এবং প্রয়োজনে এ বিষয়ে আমিও রিপোর্ট ছাপাবো। তাছাড়া আপনারা যদি সত্যি নকল ডিমের ব্যবসায়ী বা উৎপাদকের তথ্য প্রমাণ থেকেই থাকে, তবে র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দা নিয়ে সেখানে সরাসরি না যেয়ে এখানে আসছেন কেন? চলেন এখনই যাবো সেখানে। আসুন আমরা তাদের ধরিয়ে দিই এবং নিজে দায়িত্ব নিয়ে বললাম প্রয়োজনে আপনাকে (বিপিআইসিসি) থেকে পুরস্কারের ব্যবস্থা করবো। কারণ, গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য এত বড় একটি শিল্প যেখানে লক্ষ কোটি লোক জড়িত সেটি ধ্বংস হতে পারেনা।
এবার ভদ্রমহিলা ও রিপোর্টার সাহেব কিছুটা চুপসে গেলেন। আমতা আমতা করে বলতে থাকলেন, না.. মানে ইয়ে.. আমরাও শুনেছি। আমি বললাম, আপনারা না বললেন তথ্য প্রমাণ আছে। ফ্যাক্টরি চেনেন, চলেন যাই, সমস্যা কি? আমি বললাম শোনা কথা বা আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে যা করছেন তাতে করেতো তিল তিল করে গড়ে ওঠা একটা শিল্প ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এবার দুজনেই চুপ হয়ে থাকলেন। যাওয়ার আগে তাদেরকে বিনয়ের সাথে বললাম, যদি কখনো অথেনটিক সোর্স থেকে নকল ডিমের তথ্য বা প্রমাণ পান, সেগুলেঅ নিয়ে আসবেন। বিষয়টি নিয়ে আমারও আগ্রহ আছে। কিন্তু মনে রাখবেন, নস্ট এবং নকল দুটো ভিন্ন বিষয়।
ডিম খেলে মোটা হয়ে যাবো, হৃদরোগ হবে, কোলেস্টরল বেড়ে যাবে এ ধরনের ভুল ধারনা অশিক্ষিতের চেয়ে আমাদের এক শ্রেণীর শিক্ষিত এলিটদের মধ্যে বরং একটু বেশিই আছে। অথচ ডিমে বিদ্যমান কোলাইন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ডিমের মধ্যে এইচডিএল নামক যে কোলেস্টরল থাকে সেটি শরীরের জন্য উপকারী। এতে বিদ্যমান টাইপ-২ ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করে। একজন মানুষকে সারাদিন কর্মদ্যোম রাখতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল থাকে একটি ডিমে। এতে বিদ্যমান রিবোফ্লাবিন কোষে শক্তি উৎপন্ন করতে সহায়তা করে, ফসফরাস স্বাস্থ্যকর হাড় ও দাঁত ছাড়াও সেল মেমব্রেন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যারা মনে করেন, ডিম খেলে মুটিয়ে যাবেন তাদের জন্য সুখবর হলো, মাত্র একটি ডিম আপনাকে দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা থেকে বিরত রাখে। তাই শরীরের জন্য অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়েনা। সুতরাং ক্ষুধা কম, মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কম।
তবে আসল কথা হলো, সবকিছুই খেতে হবে পরিমিত। অতি খাওয়া যেমন ভালো নয় তেমনি অতি সাবধানতা সুখকর নয়। কখনো কখনো সাবধান হতে হতে আমরা কেউ কেউ এতটাই সাবধান হয়ে যাই যে, সেই সময় নিজের সাধারণ জ্ঞানটুকুও কাজ করেনা। ডিম খাওয়া নিয়ে শুধু সন্দেহ নয়, মানুষের মতো এখানেও বর্ণ বৈষম্য বিদ্যমান। অনেকের ধারনা সাদা ডিম অপেক্ষা বাদামি ডিম বেশি পুষ্টিকর। কিন্তু ধারনাটি সম্পূর্ণ ভুল। সাদা কিংবা কালো চামড়া দিয়ে যেমন মানুষের গুণ বিবেচনা করা যায়না তেমনি ডিমের রঙের ওপর এর গুণাগুণ নির্ভর করেনা। পার্থক্য শুধু সাদা পালকওয়ালা মুরগী সাদা ডিম পাড়ে, লাল পালকওয়ালা মুরগী লাল ডিম। প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া শরীরের জন্য কোন সমস্যাতো নয়-ই বরং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাওয়া যায় এখান থেকে। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ডাক্টারি পরামর্শ আবশ্যক।
শুরু করেছিলাম বাস্তব জীবনের সত্যিকার মজার ঘটনা দিয়ে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ডিম সম্পর্কে এখনো আমাদের সমাজে নানা ধরনের নেতিবাচক ধারনা এবং কুসংস্কার রয়েছে। এসব নেতিবাচক ধারনা ও কুসংস্কার দূর করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এক্ষেত্রে বিশাল ভ’মিকা রয়েছে। সবার আগে দরকার ডিম সম্পর্কে সচেতনতা। আসুন আমরা সবাই সচেতন হই।
লেখক:
মো. খোরশেদ আলম জুয়েল
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৯অক্টোবর২০