ডুমুরিয়ার নারীরা মাছের খামারে সফল

349

kbg20170718201406
শেখ হেদায়েতুল্লাহ, খুলনা থেকে: আমরা আগে মনে করতাম ভাত রান্না করা আর সন্তান লালন পালন করাই আমাদের কাজ। বাইরের কাজ পুরুষের। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা চিংড়ি চাষ করতে শিখেছি। আমরা সংসারে আর্থিক সাহায্য করতে পারছি। সংসারে আমাদের গুরুত্ব বেড়েছে। মৎস্য বিভাগ আমাদের নতুনভাবে পথচলা শিখিয়েছে। বর্তমানে এ গ্রামের ২৫ জন মহিলা একত্রিত হয়ে চিংড়ি চাষ করছে। এভাবেই মাছ চাষে নিজেদের আগ্রহী হয়ে ওঠার কথা নিউজবাংলাদেশকে শোনান সাহস গ্রামের নারী চিংড়ি চাষি রীতা চৌধুরী।

ইতোমধ্যে বাড়ির পাশে নিজেদের জমিতে পৃথক তিনটি মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন রীতা। তিনটি ছোট ঝোট খামার রয়েছে এতে। প্রতিটিতে খরচ বাদে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। এ বছর ১ বিঘা জমিতে সরকারের সহায়তায় শুরু করেছেন কাকড়া চাষ। এটিও লাভজনক বলে জানান রীতা।

তিনি বলেন, খরচ বাদে এক বিঘা জমিতে ৩৫ হাজার টাকার কাকড়া বিক্রি হয়েছে। আরও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। শুধু রীতা চৌধূরী নন ডুমুরিয়া উপজেলায় ৫ শতাধিক নারী মৎস্য চাষি রয়েছেন যারা পুরুষের পাশাপাশি নিজেরাই মৎস্য খামারে মাছের পরিচর্যায় সরাসরি জড়িত।

খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলাটি মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ ও অপার সম্ভাবনাময় একটি জনপদ। বর্তমানে ডুমুরিয়া উপজেলার জনগোষ্ঠিীর জন্য যে পরিমাণে মাছের চাহিদা রয়েছে তার তিনগুন বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে এখানে। এই উপজেলার নদী খাল ও বিলে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, কৈ টেংরা, টাকি, শোল, পুটি ইত্যাদি মাছ পাওয়া যেতো। বর্তমানে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে তা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। দেশীয় মাছকে রক্ষা করার জন্য ৫টি মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয় জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত করে অভয়াশ্রমগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করায় ওই সব অভয়াশ্রমে উল্লেখযোগ্য হারে বিপন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছের আবির্ভাব ঘটেছে।

এখন শিংগে মরা নদীতে জাল টেনে বিপন্ন প্রজাতির টেংরা, পুটি, বেলে, শিং, চিংড়ি ইত্যাদি মাছের ১০-১২ শতাংশ পুনরাবির্ভাব ঘটতে দেখা গেছে। মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোর সুফল দেখে ব্যক্তি উদ্যোগে উপজেলার হাজিবুনিয়া মরা নদীতে একটি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে। ওই সমিতির একজন সদস্য জানান, অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় এই খালে আগের চেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া মাছ চাষে নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে।

জানা যায়, বিগত এক বছরে ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস, টাউনঘোনা, গোলনা, বড়ডাঙ্গা, ভান্ডারপাড়া অঞ্চলের নারীদের দলগত প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও উদ্বুদ্ধ করার ফলে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৫ শতাধিক নারী সরাসরি মাছ চাষে জড়িত হয়ে পড়েছে। নারীরাও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।

এছাড়া চাষিদের মধ্যে পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে উপজেলার বড়ডাঙ্গা গ্রামে সৃষ্টি হয়েছে চিংড়ি চাষ পল্লী। যা সবার কাছে চিংড়ি চাষের বড়ডাঙ্গা মডেল নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে চিংড়ি সংগ্রহ কেন্দ্রে। যেখানে চিংড়ি চাষিরা সরাসরি চিংডি বিক্রি করতে পারে। সেখানে সংগ্রহকৃত চিংড়ি সরাসরি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কোম্পনিতে পাঠানো হয়। কোন ফরিয়া বা ডিপো মালিকের প্রয়োজন পড়ে না।

মৎস্য অধিদপ্তরের লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে চিংড়ি চাষের জন্য তৈরি করা হয়েছে বড়ডাঙ্গা মডেলটি। উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি করা। মৎস্য অধিদপ্তর নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের যে চালেঞ্জ নিয়েছে তারই বাস্তব প্রয়োগ হলো এই বড়ডাঙ্গা মডেল। এখানকার উৎপাদিত মাছ বা চিংড়ি বা সবজিতে কোনো কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় না। সম্পূর্ণ বিষমুক্ত পরিবেশে নিরাপদ খাদ্য তৈরি হচ্ছে এ এলাকায়।

ডুমুরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সরোজ কুমার মিস্ত্রী জানান, উপজেলায় ২১ হাজার ৭০৮ হেক্টর (১ হেক্টর= ২.৪৭ একর) জলাশয় রয়েছে। এ সকল জলাশয় মৎস্য সম্পদ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। ডুমুরিয়া উপজেলার জনগোষ্ঠির জন্য মাছের চাহিদা ৫ হাজার টন। অথচ ডুমুরিয়াতে গত অর্থবছরে (২০১৬-২০১৭) উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ১৫৯ টন। যা চাহিদার তিনগুন।

তিনি আরও জানান, সারাদেশে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে গলদার চাষ হয়। তার মধ্যে ডুমুরিয়ায় চাষ হয় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে। এ জমিতে গলদার উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ১০৭ মেট্রিক টন। যা সারাদেশের উৎপাদনের ৬ ভাগের ১ ভাগ। মৎস্য অফিসার সরোজ কুমার মিস্ত্রী আরও বলেন, “মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সরকার অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। গত বছর ডুমুরিয়ার ১২ টি বৃহৎ জলাশয়ে এবং ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের পুকুরে ১১ টন মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।” এ বছর আরও বেশি পরিমাণ মাছের পোনা অবমুক্ত করা হবে বলে তিনি জানান। কৃতজ্ঞতা: নিউজবাংলাদেশ.কম

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম