আজকাল অনেকেই ডেইরি খামার করে লাভবান হচ্ছেন। ডেইরি খামার একটি লাভজনক পেশা। কেননা গরু পালনে তেমন কোন পরিশ্রম করতে হয়না শুধুমাত্র সঠিক উপায়ে ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গরুর পরিচর্যা করতে পারলেই গরু পালনে লাভবান হওয়া যায়।
মনেকরি আপনার খামার শুরু হবে ৮ টি গরু দিয়ে এবং জায়গার পরিমাণ হবে ১৬ থেকে ৫০ ফুট ।
খরচের হিসাব
১. খামার শুরুর আগে ঘর নির্মাণ করা অতীব জরুরী। একননা ঘর নির্মাণ ছাড়া গরু পালন করা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে ঘরের দেয়াল ছাউনি বাবদ খরচ হবে ১০০০০ টাকা।
২. ৮টি গাভী ক্রয় (বাছুরসহ দুধের গাভী) প্রতিটি ৫০,০০০ করে ৪,০০,০০০ টাকা;
৩. খানার পাত্রসহ আনুষঙ্গিক খরচ ৪,০০০ টাকা;
৪. প্রতিদিন খাদ্য খরচ (১টির জন্য ১০০ টাকা) ৮টির জন্য (৮০০ x ৩০) ২৪,০০০ টাকা (প্রতি মাসে);
৫. ওষুধ, ভিটামিন (মাসিক) ১৫০০ টাকা;
৬. টিউবওয়েল স্থাপন ৮,০০০ টাকা;
৭. পানি সাপ্লাইয়ের মোটর ৮,০০০ টাকা;
৮. ৪টি ফ্যান ১৬,০০০ টাকা; মোট খরচ ৯,৮৫,০০০ টাকা।
গাভীর খামার থেকে আয়
প্রতিটি গাভী দৈনিক ১৮ কেজি দুধ দেবে। প্রতি কেজির দাম ৩০ টাকা। একটি গাভীর দুধ থেকে প্রতিদিন গড়ে পাওয়া যাবে ৩০ দ্ধ ১৮ = ৫৪০ টাকা। তাহলে ৮টি গাভীর দুধ থেকে প্রতিদিন ৫৪০ দ্ধ ৮ = ৪৩২০ টাকা আয় হবে। ফলে ৩০ দিনে ৮টি গাভীর দুধ বিক্রি থেকে ৪৩২০ দ্ধ ৩০ = ১,২৯,৬০০ টাকা। গাভী প্রায় ৮ মাস ধরে গড়ে ১৮ কেজি দুধ দেবে। এরপর দুধের পরিমাণ কমতে থাকবে। দুধ বিক্রি থেকে ৮ মাসে আয় ১,২৯,৬০০ দ্ধ ৮ = ১০,৩৬,৮০০ টাকা। প্রাথমিক খরচ ৯,৮৫,০০০ টাকা; মোট আয় = ৫১,৮০০ টাকা। ৮ মাস পর নিট লাভ ৫১,৮০০ টাকা।
তবে খেয়াল রাখা অতীব জরুরী যে আট মাস পর সাধারণভাবেই দুধের পরিমাণ কমে আসবে। সর্বসাকূল্যে সে সময় একটি গরু থেকে গড়ে আট কেজি দুধ পাওয়া যাবে। সে অনুযায়ী হিসেব করলে দেখা যায় আটটি গরু থেকে দুধ পাওয়া যাবে ৬৪ কেজি।
এবার ৬৪ কেজি দুধ যদি ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয় তাহলে,
দৈনিক আয় হবে (৬৪x ৩০)= ১৯২০ টাকা
মাসিক আয় হবে (১৯২০x৩০) = ৫৭,৬০০ টাকা
৮ মাসের আয় হবে (৫৭,৬০০x ৮) = ৪,৪০,৮০০ টাকা।
এখানে প্রথম ৮ মাসে আয় ১০,৩৬,৮০০ টাকা + পরবর্তী ৪ মাসে আয় ৪,৪০,৮০০ টাকা। মোট দুধ বিক্রি থেকে আয় ১৪,৭৭,৬০০ টাকা।
৮ মাস পর দুধ দেয়ার পরিমাণ কমে যাবে। তখন কৃত্রিম প্রজনন দিতে হবে। কৃত্রিম প্রজনন দেয়ার প্রায় ৮ মাস পর গাভী বাচ্চা দেবে। এরপর প্রতিবার ২০ কেজি করে দুধ দেবে। এ গাভী ৪ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত পোষা যাবে। ১ বছর পর এক-একটি বাছুর প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যাবে। ৩ বছর পর বাছুরগুলো আবার গর্ভবতী হবে। তখন এক-একটির দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় দাঁড়াবে। এ কারণে বাছুরগুলো রেখে ষাঁড়গুলো বিক্রি করে দিতে হবে।
গাভীকে দানাদার খাদ্য, কাঁচা ঘাস, খড়, চালের কুঁড়া ও প্রচুর পরিমাণে পানি দিতে হবে। পরবর্তী বছরগুলোতে ঘর নির্মাণ খরচ লাগবে না, গাভীও কিনতে হবে না। ৮ মাস পর আবার গাভীগুলো দুধ দেবে। আগের বাছুর বড় হবে। এসময় ঘর নির্মাণ খরচ, গাভী ক্রয় খরচ, টিউবওয়েল নির্মাণ খরচ আর লাগবে না, তবে খাদ্য খরচ বেড়ে যাবে।
এবার একটু অন্য হিসেব করা যাক,
আগের গাভী আছে ৮ টি
বড় বাছুর আছে ৮ টি
নতুন বাছুর আছে ৮ টি
তাহলে মোট গরুর সংখ্যা দাঁড়ালো ২৪ টি। বাছুর গুলোর মাঝে ষাঁড় থাকলে বিক্রি করতে হবে। ধরুন আগের ৮ টি বাছুরের মধ্যে ৪ টি বাছুর ষাঁড় তাহলে প্রতিটি ১৫০০০ টাকা ধরে বিক্রি করলেও চারটি ষাঁড়ের দাম হবে ৬০০০০ টাকা। তবে বর্ত্মান বাজারের উপর নির্ভর করবে এই লাভ বাড়বে নাকি কমবে। কেউ আবার ভাববেন না যে এটাই একদম সঠিক হিসাব। এটি জাস্ট একটি কাল্পনিক হিসেব।
এখন আট মাস বাদে বাছুর প্রসব হয়ে গেলে তখন দৈনিক খরচের পরিমাণ বেড়ে যাবে। ধরে নেই দৈনিক খরচের পরিমাণ বেড়ে যাবে ১৫০০ টাকা
মাসে খরচ বাড়বে (১৫০০x৩০)= ৪৫০০০ টাকা। এছাড়াও পানি, ঔষধ, চিকিৎসা সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক ব্যয় ৫০০০ টাকা তাহলে মোট ব্যয় এর পরিমাণ দাঁড়ালো ৫০০০০ টাকায়।
আয়
দুধ বিক্রি থেকে এক মাসে আয় ১,২৯,৬০০ টাকা; ১,২৯,৬০০ – ৫০,০০০ = ৭৯,৬০০ টাকা নিট লাভ। এছাড়া প্রতি বছর বাছুর বিক্রি থেকে এবং গোবর বিক্রি করেও টাকা অর্জন করা যাবে। গাভীগুলো ৪ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত দুধ দেয়ার পর এগুলো বিক্রি করে দিতে হবে। এ ধরনের একটি গাভী ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যাবে।
দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির চারটি কৌশল
গাভী পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য দুধ উৎপাদন। আর তার জন্য প্রয়োজন সুষম খাবার সরবরাহ, রোগাক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে যথাযথ চিকিৎসাসহ অন্যান্য দৈনন্দিন পরিচর্যা। তবে এর সাথে আরো কিছু সহজ বিষয়ের দিকে নজর দিলে দুধের উৎপাদন আশানুরূপ মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব।
দুধে আশি ভাগের বেশি পানি থাকে। বাকি ১২.৫ ভাগ ফ্যাট নয় এমন শক্ত পদার্থ যেমন- ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি। অবশিষ্টাংশ ফ্যাট। এক লিটার দুধ উৎপাদনের জন্য গাভীর প্রায় চার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। অথচ অধিকাংশ সময় গাভীকে পর্যাপ্ত পানি দেয়া হয় না। যেমন- রাতের বেলা পিপাসা লাগলেও গাভী পানি পান করতে পারে না।
গাভীকে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গাভীকে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি দিলে দুধের উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। তাই গাভী যেন প্রয়োজনমত পানি পান করতে পারে সে জন্য চব্বিশ ঘণ্টা পানির পাত্রে পানি দিতে হবে। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে গাভীকে বেশি খাবার দিলে দুধ উৎপাদন বেশি হবে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার দেয়া
গরুর খামার বিশেষ করে দুধের জন্য সযেসব খামার গড়ে তোলা হয় সেইসব খামারের গরুদের জন্য আলাদা খাদ্য ব্যবস্থাপনা করতে হয়। দুধের জন্য গাভীদের পর্যাপ্ত সুষম খাবারের ব্যবস্থা করতে না পারলে দুধের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সম্ভবপর হবেনা। তাই দ্ধের জন্য গাভীদের বিশেষ যত্নের সাথে সাথে পর্যাপ্ত সুষম খাবারও দিতে হবে।
জাবর কাটার সময় দেয়া
গাভীর জাবর কাটার সাথে গাভীর স্বাস্থ্যকর দিকটি জড়িত । গাভীর জাবর কাটার মাধ্যমে গাভীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়। গাভী যত বেশীজাবর কাটবে তার শরীরের পক্ষে ততবেশি ভাল। কেননা গাভী জাবর কাটার সময় পেলে তত বেশী লালা জাবরের সাথে মিশে পেটে চলে যাবে এতে গরুর হজম প্রক্রিয়া সহজ হয়। তাই যতটা পারা যায় গাভীকে জাবর কাটার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।
প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ
গাভীকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে হবে। প্রতি লিটার দুধে প্রায় ১.২ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকার কারণে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদনের জন্য বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয়। খাবার দেয়ার সময় ক্যালসিয়ামের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ক্যালসিয়ামের অপর্যাপ্ততা দুধের উৎপাদন ব্যহত করে। তাই গাভী যেন পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম পায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
উপরের বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে খরচ কমের পাশপাশি দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। খামারি লাভবান হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২০মার্চ২০