বরেন্দ্র ভূমিতে বিদেশি ফল ড্রাগন চাষ করে সফলতার দেখা পেয়েছেন রাজশাহীর শতাধিক চাষি। ফলটি দেখতে সুন্দর। খেতেও সুস্বাদু ও মানে ভালো হওয়ায় বাজারে চাহিদাও প্রচুর। এর ফলে রাজশাহী-নাটোর-নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ড্রাগন ফলের চাষ। শুধু চাষই নয়; বেড়েছে বিক্রিও। পানি কম ও সেচ খরচ তেমন নেই। এছাড়া বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিরা এখন আমেরিকার জনপ্রিয় এই ড্রাগন চাষে ঝুঁকছেন।
চাষিরা বলছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের আশা জাগাচ্ছে ড্রাগন ফল। ড্রাগন ফল চাষ করে ভাগ্যবদল হয়েছে শতাধিক কৃষকের। সময় বেশি লাগলেও অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন। এতে তাদের অভাব মোচন হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে চাষে আগ্রহ বাড়ছে। খরাপ্রবণ এই এলাকার মাটিতে আগে ফল তো দূরের কথা অন্যান্য ফসল তেমনভাবে উৎপাদন হতো না। কিন্তু দিন যত যায় এই অঞ্চলের মানুষের নতুন নতুন উদ্ভাবনের চিন্তা আসায় বরেন্দ্র অঞ্চলের এই মাটিতে ফলছে বিভিন্ন জাতের ফল, শাকসবজিসহ নানান ধরনের ফসল। স্ট্রবেরি, লাল তরমুজ, পেয়ারা চাষ হলেও দিন দিন ‘ড্রাগন’ ফলের চাষ বাড়ছে বহুগুণে।
জানা যায়, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ড্রাগন ফল প্রথম আমদানি করা হয়। সে সময় চড়া দামে বিক্রি হতো এই ফল। এই ফল থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে নিয়ে আসা হতো। কিন্তু এর এক দশক পর থেকে দেশেই চাষ হচ্ছে পাতাবিহীন এই ফলটি। এখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
রাজশাহী কৃষি বিভাগ বলছে, এটা এক ধরনের ক্যাকটাস জাতীয় গাছ। তবে এই গাছে ফুল ধরে। ফুল থেকেই হয় ড্রাগন ফল। ফলের গাছ সাধারণত দেড় থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। একটি ফলের ওজন কমপক্ষে ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। এর বীজগুলো খুবই ছোট, কালো ও নরম। তবে এই গাছের কোনো পাতা হয় না। প্রতি বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলে এই ফলের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি অধিপ্তর বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় ২১৪ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল ড্রাগন। আর এর উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৪১৮ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ৩২৫ মেট্রিক টন। নওগাঁ জেলায় ৪৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ৩৬০ মেট্রিক টন। নাটোর জেলায় ১৩৪ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ১ হাজার ৫৪৫ মেট্রিক টন।
এরে আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় ৫৭ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে ড্রাগন ফল উৎপাদন হয় ৬৮৮ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ২৩৪ মেট্রিক টন। নওগাঁ জেলায় ২৬ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ২২০ মেট্রিক টন। নাটোর জেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ৫৫২ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় ২৭ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে ড্রাগন ফল উৎপাদন হয় ৩২৪ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ২ মেট্রিক টন। নওগাঁ জেলায় ২২ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ১০৮ মেট্রিক টন। নাটোর জেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে উৎপাদন হয় ৬৪০ মেট্রিক টন।
কৃষি অধিদপ্তর জানায়, ড্রাগন চাষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পিছিয়ে থাকলেও রাজশাহী জেলা এগিয়ে বহুগুণ। এর সঙ্গে নাটোর জেলাতেও বেড়েছে এই ফলের চাষ। ড্রাগনের বাগান তৈরির পর সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর চারা তৈরির কাজও খুব সহজ। ডাল কেটে মাটিতে বপন করলেই সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে ড্রাগন গাছ। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে ড্রাগন ফলের। এ এলাকাকে পোড়ামাটির অঞ্চল বলা হয়। এ উপজেলায় এই মৌসুমে ড্রাগন চাষ হয়েছে ১৯০ হেক্টর জমিতে।
বরেন্দ্র ভূমিতে বিদেশি ফল ড্রাগন চাষ করে সফলতার দেখা পেয়েছেন রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুর এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে গোদাগাড়ী উপজেলার সোনাদীঘির মোড় এলাকায় ৫ একর (১৫ বিঘা) জমিতে গড়ে তুলেছেন বিশাল ড্রাগন বাগান। চারা রোপণের বছর না পেরোতেই দেখা পেয়েছেন ফলনের। নিয়মিত পরিচর্যায় সম্ভাবনার দাঁড় খুলেছে এই কৃষি উদ্যোক্তার। ২০২১ সালে এক একর (৩ বিঘা) জমিতে ড্রাগন চাষ শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ ১৭ বছরের ভোজ্যতেলের ব্যবসা ছেড়ে হয়ে যান কৃষি উদ্যোক্তা। প্রথম বছরেই প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকার ফল বিক্রি করেন।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির ধরন ড্রাগন চাষের জন্য বেশ উপযোগী। উৎপাদন বেশি ও চাষাবাদে খরচ কম হওয়ায় এর চাষ বাড়ছে। কৃষি বিভাগ উৎসাহিত করার ফলে ড্রাগান চাষ আজকের অবস্থানে এসেছে।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ বলেন, বরেন্দ্রভূমিতে ড্রাগন চাষ বেশ লাভজনক। ড্রাগন হচ্ছে মরুভূমি এলাকার ফল। এদিক থেকে রাজশাহী অঞ্চলের মাটি অধিকাংশ সময় খরায় শুষ্ক থাকে। ড্রাগন চাষ সহজসাধ্য ও চাষে খরচও কম হয়। এর ফলে পোকামাকড় কম আক্রমণ করে আবার অতি বৃষ্টিতেও এর ক্ষতি হয় না। একারণে আগের চেয়ে বর্তমানে এর চাষ বেড়েছে। কাজেই এ অঞ্চলে ড্রাগন চাষ লাভজনক।