ফলের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত নাটোরে অভিষিক্ত ড্রাগন ফলের চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অধিক মুনাফা ও অনায়াসলব্ধ ফলের কারণে প্রতিষ্ঠিত ফল চাষিরা ড্রাগন ফলের বাগান তৈরি ও এর পরিধি বাড়াতে তৎপর হয়েছেন। মান উন্নয়নে চলছে গবেষণা। নাটোরের উৎপাদিত ফল ও গাছের চারা যাচ্ছে সারা দেশে। নাটোরে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা ড্রাগনের নজরকাড়া ফুল ও ফল দেখতে এর বাগানে ভিড় করছেন।
২০০৩ সালে দেশের প্রখ্যাত ফল গবেষক ও উদ্ভাবক এস এম কামরুজ্জামান এর তত্ত্বাবধানে নাটোরের মডার্ণ হর্টিকালচার সেন্টারে থাইল্যান্ড থেকে আনা ড্রাগনের প্রথম অভিষেক ঘটে। অজানা এই গাছের ফল পেতে প্রায় তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমাদের দেশে ড্রাগন চাষ ও এর সম্প্রসারণ ঘটাতে চাষাবাদ কৌশল জানতে ২০০৯ সালে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নির্দেশনায় মন্ত্রণালয় তদানীন্তন বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার এস এম কামরুজ্জামানকে এক সপ্তাহের জন্যে ভিয়েতনাম পাঠানো হয়। ভিয়েতনামের জাতীয় ফল ড্রাগন চাষে প্রসিদ্ধ হো চি মিন এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে ড্রাগন চাষের সব কিছুই রপ্ত করতে পেরেছিলেন এই কৃষি অফিসার।
বর্তমানে মডার্ণ হর্টিকালচার সেন্টারে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা এবং চায়না থেকে আনা বিভিন্ন জাত ছাড়াও উদ্ভাবিত সর্বাধিক ১২টি জাতের দুই হাজার গাছে সর্বাধিক লাল, সাদা, গোলাপী, হলুদ এবং মাল্টি কালার- এই পাঁচ রঙে ড্রাগন ফল উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত ড্রাগন যাচ্ছে রাজধানীর কাওরান বাজার আর শ্যাম বাজারে। ঐখান থেকে পাঁচ তারা হোটেল, অভিজাত ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর এবং সারা দেশে।
পরবর্ত্তী সময়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণকারী এস এম কামরুজ্জামান বলেন, মৌমাছি কখনোই নিশাচর না হলেও অবাক করা কান্ড- জ্যোৎ¯œা রাতে ড্রাগন ফুল ফুটলে এর মনোরম সুবাসে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির আগমনে অপরুপ হয় পরিবেশ, ঘটে পরাগায়ন। পুরুষ বন্ধ্যা গাছের সাথে বিভিন্ন স্ত্রী গাছের রেণুর পরাগায়ন ঘটিয়ে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব।
এস এম কামরুজ্জামান আরো বলেন, এদেশের আবহাওয়া ড্রাগন চাষের উপযোগী হলেও বৃষ্টি এবং ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচের তাপমাত্রায় ড্রাগনের আকার ছোট হয়ে যায়। ফল বড় করা এবং ফল সংগ্রহের সর্বশেষ সময়কে দীর্ঘায়িত করে অন্তত: জানুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত করার কাজ করছি আমরা।
ড্রাগন গাছ মূল আর কান্ডে বিভক্ত, পাতা নেই। সবুজ কান্ড থেকে আবার বের হয় অসংখ্য কান্ড। অনেকটা ক্যাকটাসের মত দেখতে এসব কান্ড থেকে বের হয় কলি। আর কলি থেকে সাত থেকে দশ দিনের মাথায় নাইট ক্ইুনের মত অত্যন্ত আকর্ষনীয় ফুল। অপরুপ সুন্দর মাত্র এক রাতের এই ফুল থেকে ফলের পূর্ণতা পেতে সময়ের প্রয়োজন এক মাস।
ড্রাগনের গাছগুলোকে দাঁড়িয়ে রাখতে প্রয়োজন ছয়-সাত ফুট উচ্চতায় কংক্রিটের খুঁটি। একটা খুঁটিকে কেন্দ্র করে চারটা গাছ। অনায়াসের পরিচর্যায় প্রয়োজন নিড়ানী আর সামান্য সেচের। গাছের মূল খাবার হিসেবে প্রয়োজন শুকনো গোবর। গাছ থেকে ফল সংগ্রহের পর এক মুঠো করে টিএসপি আর পটাশ দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
খুব সহজেই কান্ডের অংশ কেটে তৈরি হয় ড্রাগনের চারা। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে গাছে ফুল পাওয়া সম্ভব। সাধারনত মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় বার ফুল থেকে ফল ধরে। একটা গাছে বছরে অন্তত: পাঁচ কেজি ফলন পাওয়া যায়। চার বছর বয়সী গাছ এবং এর পর থেকে ফলন আরো বৃদ্ধি পায়।
নাটোরে ক্রমশ: ড্রাগন চাষের পরিধি বাড়ছে। নাটোরের প্রায় সকল সফল ফল চাষির বাগানের উল্লেখযোগ্য জায়গাতে অবস্থান করে নিয়েছে ড্রাগন।
২০১৪ সালে হর্টিকালচার সেন্টারের আধা বিঘার প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে ড্রাগনের যাত্রা শুরু হয়েছিল বাইপাসে সিটি কলেজ সংলগ œ সোহাগ-সোহান নার্সারীতে। নার্সারীর সত্ত্বাধিকারী জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক আলফাজুল আলম বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শুধু ফল নয়, যাচ্ছে ড্রাগনের চারাও। শহরের মধ্যে নার্সারী হওয়ার কারণে মৌসুমের প্রায় প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ড্রাগন দেখতে আসেন। দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখর এই নার্সারি।
বাজার মূল্য ও চাহিদা বিবেচনায় অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় শহরতলীর মাঝদীঘাতে ৪০ একরের মৎস্য ও কৃষি খামারের অন্য ফল বাগানকে ড্রাগন বাগানে রুপান্তর করেছেন। এখানে ২৫ বিঘা জমির ওপরে ড্রাগনের খামার দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ বলে দাবি করেছেন খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম নবী।
দেশের বৃহত্তম এই ড্রাগন খামার দেখতে অসংখ্য দর্শনার্থী ছাড়াও পরিদর্শন করেছেন বর্তমান ও সাবেক কৃষি সচিব, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। সবুজ কান্ডে ধরে থাকা লাল রঙের ড্রাগন ফল দেখতে অপরুপ, তবে জ্যোৎনা রাতের ড্রাগন ফুল আর ফুলকে ঘিরে মৌমাছির গুঞ্জন অসাধারণ মায়াবী রাত তৈরি করে বলে জানান কলেজ শিক্ষক মাসুমা সুলতানা রুপা।
দেশের স্বনামধন্য মৎস্যচাষি ও আদর্শ ফল চাষি গোলাম নবী জানান, খামারের ১৬ হাজার ড্রাগন গাছে চলতি মৌসুমে অন্তত: ৮০ টন ফল পাওয়া যাবে। উৎপাদিত ফল স্থানীয় বাজার ছাড়াও ঢাকা, সিলেট, খুলনা,ময়মনসিংহসহ সারা দেশে নিয়মিত পাঠানো হচ্ছে। ভবিষ্যতে খামারের পরিধি আরো বৃদ্ধির পরিকল্পনার কথা জানালেন গোলাম নবী।
প্রতিষ্ঠিত ফল উৎপাদক সেলিম রেজা আহম্মদপুরে দুই একর জমিতে ড্রাগন উৎপাদন করছেন। তিনি বলেন, থাই কুল ও ষ্ট্রবেরীর মত ড্রাগনেরও অভিষেক নাটোরে এবং এস এম কামরুজ্জামান স্যারের হাতে। আশাকরি এর উন্নয়নও ঘটবে নাটোরে।
নাটোরের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বিভিন্ন ফলের দোকান, এমনকি ভ্রাম্যমান ফল ব্যবসায়ীরাও নিয়মিত ড্রাগন বিপনন করছেন। প্রতি কেজির খুচরা মূল্য তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকা। নাটোর প্রেস ক্লাব এলাকার ফল ব্যবসায়ী সোহানুর রহমান জানান, প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ কেজি করে ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে।
শুধু দর্শনধারী এবং সুস্বাদুই নয়, গুনবিচারেও অনন্য ড্রাগন। ক্যালরী কম থাকায় ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগীরা অনায়াসে এই ফল খেতে পারেন। ড্রাগন রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে বলে এটি ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আয়রনের উৎস হিসেবে ড্রাগন রক্ত শূন্যতা দূর করে। ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসে ভরপুর বলে ড্রাগন হাড় ও দেহের গঠনে ভূমিকা রাখে। ভিটামিন এ ও বি সমৃদ্ধ বলে স্নায়ুতন্ত্র ও দৃষ্টিশক্তির উপকার করে ড্রাগন। সর্বোপরি এ্যান্টি অক্সিডেন্টের ভান্ডার হিসেবে এন্টি এজিং গুনাবলীতে সমৃদ্ধ ড্রাগন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। আর কীটনাশকের ব্যবহার নেই বলে এই ফল গুণাগুণে থাকে অটুট।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, পুষ্টিমান ও আর্থিক দিক বিবেচনায় ড্রাগন অগ্রগামী এবং অপার সম্ভাবনাময় ফল। নাটোরে তাই ড্রাগন চাষের পরিধি ক্রমশ: বাড়ছে। সূত্র: বাসস
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম