ঢেঁড়স বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি। দেশের সব অঞ্চলের লোকের কাছেই এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। আমাদের দেশে ঢেঁড়স মূলত ভাজি, ভর্তা ও তরকারির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঢেঁড়সে প্রতি ১০০ গ্রামে ভক্ষণযোগ্য অংশে আমিষ (১.৮ গ্রাম) ভিটামিন-সি (১৮ মিলিগ্রাম) খনিজ পদার্থ বিশেষ করে ক্যালশিয়াম (৯০ মিলিগ্রাম), লোহা (১ মিলিগ্রাম) ও আয়োডিন রয়েছে।
জলবায়ু ও মাটি: ঢেঁড়সের জন্য অপেক্ষাকৃত উচ্চতাপমাত্রা প্রয়োজন। শুষ্ক ও আর্দ্র উভয় অবস্থায় ঢেঁড়স জন্মানো যায়। সাধারণত খরিফ মৌসুমেই এর চাষ হয়ে থাকে। দো-আঁশ মাটি ঢেঁড়সের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট। প্রচুর জৈবসার প্রয়োগ করতে পারলে বেলে ধরনের মাটিতেও এর চাষ করা যায়। মাটি সুনিষ্কাশিত হওয়া প্রয়োজন।
জাত ও বৈশিষ্ট্য: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ১৯৯৬ সনে হলুদ শিরা রোগ প্রতিরোধী বারি ঢেঁড়স -১ অবমুক্ত করে। বারি ঢেঁড়স-১ এর গাছ অবিরত, খাড়া, প্রধান কান্ড থেকে ২-৩টি শাখা বের হয়। ফল সবুজ, প্রস্থচ্ছেদে পাঁচকোণী, দৈর্ঘ্য ১৪-১৮ সেমি.। জাতটি বাংলাদেশের বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বীজ বপনের সময় ও পরিমাণ: বাংলাদেশে সাধারত ফেব্র“য়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ঢেঁড়স লাগানো হয়। তবে বছরের অন্যান্য সময়ও সীমিতভাবে এর চাষ হয়ে থাকে। প্রতি হেক্টরে বপনের জন্য ৪-৫ কেজি (১২-২০ গ্রাম/শতাংশ) বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি নির্বাচন ও তৈরি: সেচ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ উঁচু জমি নির্বাচন করে ৫-৬ বার চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। এরপর মাঠে সরাসরি বীজ বপনের জন্য এক মিটার প্রস্থ মিড়ি বা বেড তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি দুটি মিড়ির মাঝখানে ৩০ সেমি. প্রস্থ পিলি বা নালা রাখতে হবে। মিড়ি সাধারণত ১৫-২০ সেমি. উঁচু হবে।
বীজ বপনের পদ্ধতি ও দূরত্ব: আগাম ফসলের জন্য বীজ ঘন করে বপন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারি ৪৫ সেমি. এবং সারিতে ৩০ সেমি. পর পর লাইনে ৩০ সেমি. অন্তর বীজ বপন করা হয়। সঠিক মৌসুম ফসলের জন্য অর্থাৎ বৈশাখ মাস থেকে (১৫ এপ্রিলের পর) এক মিটার প্রস্থ বেডে ৬০-৪০ সেমি. দূরত্বে দুই সারিতে বীজ বপন করতে হবে। বীজ মাটির ২-৩ সেমি. গভীরে বুনতে হয়। এক সাথে ২টি বীজ বপন করা ভালো। বীজ বপনের আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নিলে অঙ্কুরোদগম ভালো হয়। বপনের পর প্রয়োজনীয় পানি সেচ আবশ্যক। চারা গজানোর ৭ দিন পর সুস্থ সবল একটি গাছ যথাস্থানে রেখে অতিরিক্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে।
সেচ ও পানি নিষ্কাশন অন্যান্য পরিচর্যা: সময়মতো নিড়ি দিয়ে আগাছা সব সময় পরিষ্কার করে সাথে সাথে মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে।
পোকা ও রোগবালাই দমন: ঢেঁড়সের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। লক্ষণ : ডিম থেকে বাদামি রঙের কীড়া বের হয়ে ডগা বা কচি ফলে আক্রমণ করে। কীড়া ডগা ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে ভেতরের নরম অংশ কুরে কুরে খায়। আক্রান্ত ডগা নেতিয়ে পড়ে ও শুকিয়ে যায় ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
ফসল সংগ্রহ: ফেব্র“য়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে বীজ বপন করলে ৪০-৪৫ দিনে এবং এরপর বপন করলে ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে ফুল ফুটতে শুরু করে। তবে জাতভেদে কোনো কোনো সময় একটু দেরি হতে পারে। ঢেঁড়সের ফল সংগ্রহের সময় নির্ণয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফুল ফোটার ৫-৬ দিন পর থেকেই ফল সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত ফলের পরাগায়নের ৭-৮ দিন পর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়। ফলের বয়স ১০ দিনের বেশি হলে ফল আঁশময় এবং পুষ্টিমানের দিক দিয়ে নিকৃষ্ট হতে শুরু করে। ফল যত পাড়া যায় গাছ তত বেশি ফল উৎপাদন করে। এক দিন পর পর প্রতিদিনই ঢেঁড়েসের ক্ষেত থেকে ফল সংগ্রহ করা উচিত। কচি ফল সংগ্রহ করলে ফলন সামান্য কমে কিন্তু ফলের স্বাদ ও পুষ্টিমান অনেক বেড়ে যায়।
ফলন: উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে ঢেঁড়সের ফলন হেক্টরপ্রতি ১৪-১৬ টন (৫৫-৬৫ কেজি/শতাংশ) পাওয়া যায়।
বীজ সংগ্রহ শুকানো ও সংরক্ষণ: ফল পাকার পর ফেটে যাওয়ার আগে তুলে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ থেকে কোনো ফল সংগ্রহ করা যাবে না। এতে বীজবাহিত ভাইরাস দ্বারা পরবর্তী ফসল আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। ভালো ফলন এবং উন্নত গুণসম্পন্ন বীজের জন্য ৩য় বা ৪র্থ নোড (গিঁট) থেকে ফল সংগ্রহ শুরু করা উত্তম। ফুল ফোটার ৩৫ দিন পর সংগৃহীত ফলে বীজের ফলন ও গুণাগুণ সবচেয়ে ভালো থাকে। তাই পরিপক্ব ফল সংগ্রহের পর এক সপ্তাহ পরিষ্কার মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা হয়। অতপর মাড়াই এবং পরিষ্কার করে শুকাতে হবে এবং শুকনা ও ঠাণ্ডা জায়গায় গুদামজাত করতে হয়। সাধারণত ৭-৮% আর্দ্রতায় গুদামজাত করলে মোটামুটি ২ বছরে বীজের সতেজতা হারায় না।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৫ফেব্রু২০২০