বাংলাদেশের কৃষিতে অগ্রগতির খবর আমরা পত্র-পত্রিকা, টিভি-রেডিও নিউজে হরহামেশাই পাই। ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন, বিষমুক্ত সবজি চাষের কৌশল, প্রতিকূল পরিবেশে ফসল আবাদ ইত্যাদি নানান খবর আমাদের আনন্দিত করে। কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিনিয়ত কৃষি গবেষণায় নতুন মাত্রা সংযোজনে নিয়োজিত। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপের মুখেও সুনির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে অধিকতর ফসল ফলিয়ে দেশের খাদ্যের চাহিদা মিটানোর জন্য কৃষিবিদ এবং কৃষকের অবদান অনস্বীকার্য। তবে তথ্য প্রযুক্তির এই বিশ্বে অন্যান্য খাতের মতো কৃষি খাতকেও বেগবান করতে তথ্য প্রযুক্তির (আইসিটি) হাওয়া বাংলাদেশের কৃষিতেও লেগেছে। এদেশের কৃষক এখন ‘ল্যাপটপ’ চেনেন, ‘কম্পিউটার’ নামের যন্ত্রে কৃষিসহ অনেক তথ্য পাওয়া যায়, তা জানেন। ‘
মোবাইল’- এ ফোন করে চাষাবাদের সমাধান কিভাবে পেতে হয়, এদেশের কৃষকরাও এখন তা শিখে গেছেন। খুব অল্প দিন হলো তথ্য প্রযুক্তির সাথে এদেশের কৃষকের পরিচয় হয়েছে। মোবাইল ফোন এখন কৃষকের নিত্যসঙ্গী। মোবাইল ফোনে একটি নির্দিষ্ট নম্বর টিপে সে কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান পেতে পারে। বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য এটি তথ্য প্রযুক্তির একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। মোবাইলে কৃষিতথ্য পাবার সাথে সাথে কৃষকরা তার গ্রামের টেলিসেন্টারটিতেও (তথ্যকেন্দ্রে) যাওয়া-আসা করেন। বাংলাদেশে এখন সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে প্রায় ৩০০০ এরও বেশি টেলিসেন্টার রয়েছে।
এ তথ্যকেন্দ্রগুলো থেকে কৃষি, স্বাস্থ্য, নাগরিক সেবা, আইনী সহায়তা, ব্যবসায়িক তথ্যাবলীসহ নানান তথ্য পাওয়া যায়। কৃষকরা তাদের প্রয়োজনটুকু এখানে খুলে বলতে পারে। অনেক কৃষক ‘তথ্যকেন্দ্র কর্মীকে’ মাঠে নিয়ে যান। তার ক্ষেতের রোগাক্রান্ত ফসল বা পাতার ছবি তুলিয়ে, ই- মেইল করিয়ে, বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করান। কৃষকদের এই আগ্রহ এবং নতুন প্রযুক্তির প্রতি আকৃষ্টতা সত্যিই প্রশংসনীয়। হয়তো এমন কৃষকের সংখ্যা মুষ্টিমেয়, তবুও আমরা আশা রাখতে পারি, সহজলভ্য ও স্বল্প সময়ে প্রাপ্ত তথ্যের জন্যই কৃষক ‘তথ্য প্রযুক্তি’ কে সহজভাবে গ্রহণ করবে।
সরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এআইসিসি (এগিকালচার ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন সেন্টার) এবং এফআইসিসি (ফিশারীজ ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন সেন্টার) কৃষকদের জন্য কৃষিতথ্যের পাশাপাশি নানান ডকুমেন্টারী, ছবি, ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদিও সংযোজন করেছে। তথ্য প্রযুক্তি যেনো কৃষকদের কাছে সহজবোধ্য হয় এজন্যই সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে এই একত্র প্রচেষ্টা। ‘কৃষি সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ মাটি পরীক্ষার জন্য তৈরি করেছে ‘সারের প্রয়োগমাত্রা নিরূপণের সফটওয়্যার’। মাটিতে কি কি উপাদান আছে তা মাটি পরীক্ষা করে বের করে, এই সফটওয়্যারে বসিয়ে, সেইসাথে জমির পরিমাণটুকু বসিয়ে দিলেই কৃষক বা কৃষিবিদ জেনে যাবেন, তার জমিতে কি পরিমাণ সার লাগবে। তথ্য প্রযুক্তির এই সুফলটিও মাঠ পর্যায়ে অনেক কৃষক এখন গ্রহণ করছে। ত্রিশটি এলাকার প্রায় ২৪০০ জন কৃষক এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে তাদের জমিতে সার প্রয়োগ করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এর ফলে সারের পিছনে কৃষকদের ব্যয় কমে এসেছে, কৃষকের উৎপাদন ভালো হয়েছে এবং মাটির গুণাগুণ উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে এই প্রযুক্তিটি একশটি এলাকায় ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু কম্পিউটার আর মোবাইলই নয়, টিভি, রেডিওতেও এখন কৃষি তথ্য নিয়ে অনেক বেশী প্রচারণা চলছে। জাতীয় সংবাদে ‘কৃষি সংবাদ’ নামে আলাদা অংশ যুক্ত হয়েছে। অনেক টিভি শুধু ‘কৃষি সংবাদ’ নামেই খবর পরিবেশন করছে। এসবই তথ্য প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সুফল। তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা ভাবছেন তথ্য প্রযুক্তিকে আরো কতটা কৃষি বান্ধব করা যায়।
সম্প্রতি দেশে কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান টেলিসেন্টার কেন্দ্রিক কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছে। সেখানে কৃষক তার কৃষিপণ্য সরাসরি তথ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসে, যেখান থেকে সে চাষাবাদের তথ্য সুবিধা পেয়েছিলো। তারপর সেই তথ্যকেন্দ্রে থেকে কৃষিপণ্য সোজা চলে আসে ঢাকার বড় কোন পাইকারী বাজারে কিংবা ‘চেইন শপ’গুলোতে।
এক্ষেত্রে কৃষক পান তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য। সেইসাথে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরত্ম্য থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। তথ্য প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষিতে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, তার সুফল কৃষকরা পেতে শুরু করেছেন। প্রযুক্তিবিদরা আশাবাদী, কৃষিবিদদের সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তারা তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুফল পৌঁছে দিতে পারবেন বাংলাদেশের কৃষকদের দোরগোড়ায়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৯জুন২০