তিন শর্তে বিদেশি বীজ আমদানির শুল্ক প্রত্যাহার

1577
images
দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে বীজ আমদানির কোনো বিকল্প নেই। দেশীয় বীজে যে ফলন হয় তা দিয়ে কোনোভাবেই উৎপাদনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে পেঁয়াজ, মরিচ, গম, সরিষা, সব ধরনের ডাল ও সবজির বীজ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

১ ডিসেম্বর রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক শাখা এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে বিদেশ থেকে সবজির বীজ আমদানির ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও রপ্তানিকারকদের দেশের প্রত্যয়নসহ আমদানিকারকদের তিনটি শর্ত মানতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বিদেশ থেকে পেঁয়াজ, মরিচ, গম, সরিষা ও সবজির বীজ আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের আইন মেনে আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও সম্পূরক শুল্কসহ নির্ধারিত অন্য শুল্ক দিতে হয়। এর ফলে বীজের দাম বেড়ে যায়। তাই বীজ আমদানি সহজ করতে সব ধরনের শুল্ক অব্যাহতির নির্দেশনা দিয়েছে এনবিআর। তিনটি শর্ত মেনে আমদানিকারকরা শুল্ক ছাড়াই বিদেশ থেকে বীজ আমদানি করতে পারবে।

তবে বিদেশ থেকে ব্যাগজাত (প্রতি ব্যাগে সর্বোচ্চ ২৫ কেজি) সবজির বীজ আমদানির জন্য এলসি খোলার আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের (বীজ) কাছ থেকে বীজের পরিমাণ ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে অনুমতি নিতে হবে। সেই অনুমতির কপিও শুল্কায়নের সময় কাস্টমসের কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিতে হবে।

এ ছাড়া ‘কোনো অবস্থায় মোড়কবিহীন বীজ আমদানি করা যাবে না’ বলে প্রঞ্জাপনে উলেস্নখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বীজের প্যাকেট বা মোড়কের ওপর ‘কেবল বপনের জন্য বীজ’ ট্যাগ লাগিয়ে ও বীজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উলেস্নখ থাকতে হবে বলেও ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে।

রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আগে মরিচের বীজ আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক, ২০ শতাংশ পরিপূরক শুল্ক এবং তিন শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক প্রযোজ্য ছিল, আর ধনিয়া বীজ আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক ছিল। সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ডাল আমদানিতে শুল্ক ছিল না। তবে আমদানিকারকদের শিম, ছোট লাল মটরশুঁটি, সাদা মটরশুঁটি, শিম, গরুর ডাল, ঘোড়ার মটরশুঁটি এবং কবুতরের মটর আমদানিতে পাঁচ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো।

এদিকে বীজ আমদানিকারকরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বীজ আমদানিতে সকল প্রকার শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ধনিয়া বীজ সম্পর্কে তারা দাবি করেছিলেন যে বীজ উৎপাদনের পক্ষে দেশের আবহাওয়া উপযোগী না হওয়ায় তারা বীজ আমদানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হাইব্রিড ও উফশী জাতের বীজ ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ আমাদের দেশীয় বীজে যে ফলন হয় তা দিয়ে কোনোভাবেই উৎপাদনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। এর ফলে ধান, গমসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্যের দেশীয় বীজ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

বীজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বীজে সয়লাব দেশীয় বাজার। চাহিদা থাকলেও বাজারে দেশীয় বীজের সরবরাহ একেবারেই কম। আগে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় অহরহ দেশি শস্যের বীজ মিললেও এখন তা দষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। আর বেশি ফসলের আশায় মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা বীজের ওপর। দেশে চায়না, ভিয়েতনাম, ভারত, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের উচ্চফলনশীল জাতের বীজ মিলছে।

সিদ্দিক বাজার কৃষি মার্কেটের চাঁদ সিডের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল জলিল যায়যায়দিনকে বলেন, দেশি প্রজাতির বীজের চাহিদা শতভাগ কমে গেছে। যার কারণে স্থানীয় প্রজাতির বীজ দোকানে রাখা হচ্ছে না। অন্যদিকে চাহিদা বেড়েছে আমদানিকরা বাহারি মোড়কের হাইব্রিড বীজের। তিনি আরও বলেন, ১০ বছর আগে ৪০ থেকে ৫০ ধরনের দেশি বীজ বিক্রি করতেন তিনি। বর্তমানে তার দোকানে দেশি বীজ রয়েছে শুধু তিন জাতের।

একই মার্কেটের সালমা কৃষি সিডের স্বত্বাধিকারী জহিরুল ইসলাম বলেন, একটা সময় ছিল যখন চাষিরা নিজের জমিতে ফলানো ফসল থেকে ভালো জাতের বীজটি সংরক্ষণ করতেন। পরবর্তী মৌসুমে আবার তা থেকেই ফসল ফলাতেন। কিন্তু এখন তা আর কেউ করেন না। করলেও অনেক কম। যার কারণে কৃষকরা হাইব্রিড বীজের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। আর সে কারণেই কৃষকদের জন্যই আমদানিকৃত হাইব্রিড বীজ বেশি রাখতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, হাইব্রিড সবজি দেশের উৎপাদনের হার ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে, ফলে সবজি মানুষের জন্য সহজলভ্য হয়েছে, যা আগে ছিল না।

এদিকে দেশি বীজ সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, দেশি বীজের চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা এখন দেশেই হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করছে। বিএডিসির আবিষ্কৃত টমেটোর বীজটি কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তাই দেশে নতুন আরও কয়েক প্রজাতির হাইব্রিড বীজ তুলতে চায় তারা।

এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের মোট বীজ চাহিদার ২২ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে বলে দাবি করলেও বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোর এক গবেষণায় তা ১২ শতাংশ বলে জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন বিভিন্ন বীজের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরকার সরবরাহ করে সব মিলিয়ে এক লাখ টনেরও কম।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উয়িংয়ের সূত্রে জানা গেছে, মোট চাহিদার ২২ শতাংশ বীজ সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয়। দেশে প্রতিবছর বিভিন্ন ফসলের প্রায় ১৫ লাখ টন বীজ প্রয়োজন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বীজ আমদানি করা হয়।