আধুনিক প্রযুক্তি কিংবা উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে নয় কেবল মাত্র তুষ-হারিকেন আর লেপ ব্যবহার করে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা গ্রামে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হচ্ছে। এ পদ্ধতিকে তুষ-হারিকেন পদ্ধতি বলে। দামিহা গ্রামের আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানো শুরু করেন। এ কারণে দামিহা গ্রাম এখন হাঁসের বাচ্চার গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোতে খরচ অনেক কম হওয়ায় দিন দিন এই পদ্ধতিটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে এখন আর এই পদ্ধতিটি শুধু দামিহা গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই।
পাশ্ববর্তী কাছিলাহাটি, রাহেলা গ্রামসহ উপজেলার ১০টি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের ৮০টি হ্যাচরিতে প্রতি মৌসুমে হাঁসের ডিম থেকে প্রায় ২ কোটি বাচ্চা ফোটানো হয়। অনেক শিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত বেকার যুবক তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন স্বাবলম্বী। উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধুমাত্র নিয়মানুবর্তিতাকে পুঁজি করেই যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
দামিহা গ্রামের মৃত আরব আলীর দ্বিতীয় ছেলে আবুল হোসেন পরিবারের অগ্রছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে স্কুল ছেড়ে কৃষি কাজে যোগ দেন। কিন্তু চাষাবাদ ভাল না লাগায় তিনি নতুন কিছু করার আশায় অন্য কোন পেশায় যোগ দেয়ার অপেক্ষা করছিলেন। ১৯৯১ সালে শেষের দিকে তিনি পরিচিত একজনের মাধ্যমে ঢাকার সাভার যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর ওপর মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ১৯৯৪ সালের প্রথম দিকে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ে হাঁস-মুরগী পালনের ওপর আরও একমাস প্রশিক্ষণ নিয়ে দামিহা বাজারে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজ শুরু করেন।
প্রথম দিকে সুবিধা করতে না পারলেও হাল ছাড়েননি আবুল হোসেন। এভাবে প্রায় দুই বছর চেষ্টার পর পুরো প্রক্রিয়াটি আয়ত্ব করে সাফল্যে অর্জনে সক্ষম হন তিনি। আবুল হোসেনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এই পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর কাজ শুরু করেন দামিহা গ্রামের বাসিন্দা মো. নূরুল গণি, সবুজ মিয়া ছাড়াও পাশের কাছিলাহাটি গ্রামের আব্দুল খালেক ও রাহেলা গ্রামের আবুল হাশেম, নজরুল ইসলামসহ অনেকেই। বর্তমানে উপজেলায় ৮০টির মতো হ্যাচারিতে এই পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফোটানো হচ্ছে। এর মধ্যে দামিহা, কাছিলাহাটি ও রাহেলা গ্রামে ৫০টি এবং মাগুরী, কাজলা, দেওথান, পুরুড়া. রাউতি, ধলা, জাওয়ার গ্রামে রয়েছে বাকি ৩০টি হ্যাচারি।
তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদন প্রক্রিয়া
তুষ পদ্ধতির একমাত্র তাপ পরিমাপ যন্ত্র থার্মোমিটার ছাড়া আর সবই দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহার করা হয় স্থানীয়ভাবে তৈরী ‘সিলিন্ডার’ নামে পরিচিত বিশেষ পাত্র, ডিম রাখার মাচা এবং উৎপাদিত হাঁসের বাচ্চা রাখার শেড। বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে ওই বিশেষ পাত্র ও মাচা তৈরী করা হয়। এছাড়া প্রয়োজন হয় তুষ, হারিকেন, লেপ, রঙ্গিন কাপড়সহ আনুষাঙ্গিক কিছু উপকরণ।
ডিম উৎপাদনের জন্য ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। তবে, এই তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠানামা করলেও সমস্যা হয় না। ৯শ ডিমের জন্য একটি কাঠের বাক্সের পরিমাপ হল- দৈর্ঘ্য ৫ ফুট, প্রস্থ ৩ ফুট ও উচ্চতা ৩২ ইঞ্চি। উপর দিক খোলা এই বাক্সে দুইটি বাঁশের চটির তৈরি সিলিন্ডার যা দেখতে অনেকটা তেলের ড্রামের মতো। সিলিন্ডারের ব্যাস ১৮ থেকে ১৯ ইঞ্চি এবং উচ্চতা হবে অনধিক ২৭ ইঞ্চি। কাঠের বাক্সে ৫ ইঞ্চি পরিমাণ দেশীয় ধানের মোটা তুষ বিছিয়ে পাশাপাশি সিলিন্ডার দুইটি বসিয়ে দিতে হয়। এর ফলে সিলিন্ডারের বাহির অংশ ও বাক্সের ভিতর অংশে সৃষ্ট ফাঁকা বর্ণিত মোটা তুষ দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হয়।
বাক্স তৈরী হয়ে গেলে উর্বর ডিম বাছাইয়ের পালা। সঠিকভাবে প্রজনন হয়েছে এ রকম মাঝারি সাইজের ডিমকে উর্বর ডিম বলে। ডিম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অধিক বড় এবং একবারেই ছোট ডিম এড়িয়ে যাওয়া ভাল। ডিম সংগ্রহের পর জীবাণুনাশক দিয়ে সেগুলো ধুয়ে বাছাই করে রোদে শুকানো হয়।
এরপর ডিমগুলো রঙ্গিন কাপড়ের থলেতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভরে সিলিন্ডারের ভেতরে রাখা হয়। পরিস্কার করা ডিম রঙ্গিন কাপড়ের পুটলিতে ২৫ থেকে ৫০ টি ভরে মুঠি বাঁধতে হয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন ডিম গুলো যাতে পুটলির মুঠি ধরে নিচ থেকে উপরে চাপ দিলে ভিতরে রাখা ডিম গুলো সহজেই ঘুরতে পারে।
এভাবে একই মাপের একটি বক্সের একটি সিলিন্ডারে প্রায় ৯শ ডিম সাজিয়ে অপর সিলিন্ডারে কেরোসিনের চালিত একটি হ্যারিকেন রাখতে হয় এবং ডিম বসানোর পরে পাটের মোটা চট দিয়ে ঢেকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ডিম গুলো শুরু থেকে ১৬ দিন পর্যন্ত প্রতি ৫ থেকে ৬ বার উপরের ডিম নিচে আর নিচের ডিম উপরে রেখে উল্টেপাল্টে দিতে হবে আর হ্যারিকেনের সিলিন্ডার পরিবর্তন করতে হবে। থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হয়। তাপমাত্রা বেশী হলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এছাড়াও সিলিন্ডারের মুখ খোলা রেখে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
১৬ দিনের পর ডিম গুলো কাঠের ওপরে ৫ ইঞ্চি পরিমাণের তুষের বিছানা বা লিটার তৈরী করে একে একে ডিম গুলো পাশাপাশি বসাতে হবে এবং মোটা পাঁটের চট দিয়ে ঢেকে দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তাপমাত্রা যেন পূর্বের মতোই হয়। ডিমে বাচ্চা আসার কারণে ডিমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়।
এ সময় বিছানায় থাকা ডিম গুলো ২ঘন্টা পর পর নাড়াচাড়া করে দিতে হয় যাতে করে বাচ্চা খোলস ভেঙ্গে বেরুতে সহজ হয়। প্রতি ক্ষেত্রেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে নাড়াঁচাড়া করতে গিয়ে ডিম ফেঁটে বা ভেঙ্গে না যায়। এভাবে পরিচর্যা করলে ২৬ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে পূর্ণ বাচ্চা পাওয়া যায়।
সাফল্য
দামিহাসহ অন্যান্য গ্রামের তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর মোট ৮০টি হ্যাচারিতে এই পদ্ধতিতে প্রতি মাসে পর্যাক্রমে চারবার ডিম ফোটানো হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে জানুয়ারি মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই মাস বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ ছাড়া বছরের বাকি সময় ডিম ফোটানোর কাজ অব্যাহত থাকে।
৮০টি হ্যাচারি থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। এসব বাচ্চা ফোটানোর জন্য হাঁসের ডিম সংগ্রহ করা হয় কালিয়াজুরী, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী, করিমগঞ্জ, মদন উপজেলাসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এ জন্য হ্যাচারি মালিকদের সঙ্গে ডিম উৎপাদনকারী খামারীদের অগ্রিম দাদন দিয়ে চুক্তি করতে হয়।
খরচ ও আয়
এই প্রক্রিয়ায় প্রতি ১০০ বাচ্চা উৎপাদনে ডিমের মূল্যসহ এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। প্রতি ১০০ বাচ্চা বিক্রি হয় দুই হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। এভাবে প্রতি বাচ্চা উৎপাদনে গড়ে লাভ হয় ৬ থেকে ৭ টাকা। সময় বেঁধে এ লাভের পরিমাণ কম-বেশী হয়। এক দিন বয়সী হাঁসের বাচ্চাগুলো পাইকাররা কিনে নিয়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, যশোর, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, খুলনা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
তুষ-হারিকেন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন, দামিহা গ্রামের সুমন মিয়া, সবুজ মিয়া, রাহেলা গ্রামের মো. আবুল হাশেম একই গ্রামের নজরুল ইসলাম ও কাছিলাহাটি গ্রামের কাজল মিয়া। এলাকায় এই পদ্ধতি পচ্চলন করায় আবুল হোসেনের প্রতি তাঁরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তিতে বসবাস করছি। দামিহা গ্রামের ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর ফলে এলাকার পরিচিতি যেমন বেড়েছে, তেমনি বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি তাঁরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হচ্ছে। তিনি আরোও বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে এলাকায় কোন হ্যাচারি ছিল না। বর্তমানে এটি একটি শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই বেকার ছিলেন। এখন তাঁরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে।
প্রয়োজন সরকারি পৃষ্টপোষকতা
স্থানীয় হ্যাচারীগুলোর প্রতি প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের উদাসিনতার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি ঋণ সুবিধা না থাকায় তাঁরা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে হ্যাচারী চালাতে বাধ্য হচ্ছে। দামিহা হ্যাচারী মালিক সমিতির সভাপতি ও এ অঞ্চলে প্রথম তুষ-হারিকেন পদ্ধতির হ্যাচারি মালিক আবুল হোসেন বলেন, সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হলে এ শিল্প আরও এগিয়ে যাবে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ছাইফুল ইসলাম বলেন, আমি দেশের বিভিন্নস্থানে চাকুরি করেছি। আমার জানামতে এত বিপুল পরিমাণ হাঁসের বাচ্চা দেশের আর কোথাও ফোটানো হয় না। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে এ এলাকার হ্যাচারি শিল্প আরও সমৃদ্ধ হয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
উপসংহার
হাঁস বা মুরগির ডিম থেকে কৃত্রিমভাবে বাচ্চা ফোটানোর জন্য বিভিন্ন হ্যাচারি শিল্পে সাধারণত বড় বড় ইনকিউবেটর ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। ব্যয়বহুল আর সহজলভ্য না হওয়ায় সাধারণ খামারিরা এটি ব্যবহার করতে পারেন না। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য যে তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় তা ইনকিউবেটরের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
ইনকিউবেটরের মাধ্যমে একসাথে অনেকগুলো ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে হাওড় অঞ্চলের খামারিরা তৈরি করেছেন অভিনব এক পদ্ধতি। এই পদ্ধতি হাওড় অঞ্চলের খামারিদের হাঁস পালন করে জীবিকা নির্বাহের পথকে সুগম করে দিয়েছে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর এই প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়েছে গ্রাম বাংলায় প্রাপ্ত সব দেশীয় উপাদান, ফলে এই প্রযুক্তি দামে যেমন সস্তা তেমনি ফলপ্রসূ।
লেখকঃ
মো. আব্দুর রহমান
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
ফার্মসএন্ডফার্মার/০১ফেব্রুয়ারি২০২১