দিনাজপুরে লিচুর বাগানে মৌ-চাষের ধুম

745

দিনাজপুর-লিচু
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকে: দিনাজপুরে প্রকৃতির রসগোল্লা খ্যাত সুস্বাদু ও মিষ্টি লিচুর বাগানে এখন মৌ-চাষ হচ্ছে। লিচু বাগানে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শতাধিক মৌ-চাষি। এর ফলে একদিকে যেমন মৌ-চাষিরা মধু সংগ্রহ করে লাভবান হচ্ছেন অন্যদিকে মৌ মাছির মাধ্যমে মুকুলে মুকুলে পরাগায়ন ঘটায় লিচু গাছ মালিকরা বাম্পার ফলনের আশা করছেন। এক কথায় বাগানে মৌ চাষ করে মৌচাষি এবং বাগান মালিক উভয়ে লাভবান হচ্ছে।

ধানের জেলা দিনাজপুরে প্রকৃতি’র রসগোল্লা খ্যাত “লিচু” গাছে মৌ-চাষে ধুম পড়েছে। মৌ মৌ গন্ধে গাছে গাছে বাতাসে দোল খাচ্ছে লিচুর মুকুল। বেদনা, বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না থ্রি, কাঠালীসহ দেশীয় লিচু গাছগুলোতে এবার প্রচুর মুকুল ধরেছে। তাই, লিচু চাষিরা এখন ব্যস্ত লিচু গাছ পরিচর্যায়। চাষিরা এখন কামনা করছে বৃষ্টির। আবহাওয়ার অনুকুলে থাকলে এবার কৃষিবিদরা লিচুর বাম্পার ফলনের আশা করছে।

গাছে থোকা থোকা লিচু মুকুল আগমনই বলে দিচ্ছে এবার লিচুর ভালো ফলন হবে এ জেলায়। তাই দিনাজপুরের লিচু চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন লিচু গাছের পরিচর্চায়। অনেকে ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক স্প্রে করছে গাছে। লাভজনক ফল হওয়ায় অনেকে ধান ও অন্যান্য ফসলের জমিতে লিচুগাছ লাগিয়েছে।

দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় ৩ হাজার ৩শ হেক্টর জমিতে রয়েছে লিচুর বাগান। এছাড়াও বসতবাড়িতে ৫শ ৪০ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। ছোট বড় মিলে সাড়ে ৪ হাজার বাগানে রয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৪ হাজারের বেশি লিচুর গাছ। প্রতি বছর লিচু বিক্রি থেকে অর্জিত হয় অনুমানিক ৯০ থেকে একশ কোটি টাকা।

আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে এবার প্রায় ৮ লাখ ৫শ ২ মে. টন লিচু উৎপাদন হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. তৌহিদুল ইকবাল জানান, প্রকৃতি এবং আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে এবার দিনাজপুরে লিচুর ফলন হবে বাম্পার। বেদনা, বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না থ্রি, কাঠালীসহ দেশীয় লিচু গাছগুলোতে এবার রেকর্ড পরিমাণ ফলন আশা করা হচ্ছে। সদর, বিরল, কাহারোল চিরিরবন্দর, বীরগঞ্জ পার্বতীপুর এলাকার লিচু বাগানগুলোতে প্রচুর মুকুল ধরেছে। লিচুর মুকুল রক্ষা ও রোগ বালাই থেকে মুক্ত রাখতে নিয়মিত লিচু চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।

লিচু বাগান পরিচর্যা আর পাহারা দিয়ে ভালো ফলন পাবেন এই প্রত্যাশা বাগান মালিক এবং আগাম অর্থ দিয়ে কেনা লিচু বাগান ক্রেতাদের।

এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌচাষি এসে বাগানে ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির মৌমাছির বাক্স বসিয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৌ চাষ করে মধু সংগ্রহ করছেন। বাগানে তারা শতাধিক ব্রুড ও নিউক্লিয়াস নামের ছোট বড় কাঠের বাক্স স্থাপন করেছেন। প্রতিটি বাক্সে একটি রানী মৌমাছি, একটি পুরুষ মৌমাছি ও অসংখ্য এপিচ মেইলিফ্রা জাতের কর্মী মৌমাছি রয়েছে। কর্মী মৌমাছিরা মৌ মৌ গন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে যায় লিচুর মুকুলে। পরে মুকুল হতে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছির দল নিজ নিজ কলোনিতে মৌচাকে এনে জমা করছে।
১০/১৫ দিন অন্তর অন্তর প্রতিটি বাক্স হতে চাষিরা ৬/৭ মণ মধু সংগ্রহ করছেন। যে লিচু গাছে মৌমাছির আগমন বেশি হয় সে গাছের মুকুলে পরাগায়ন ভাল হয়। ফলে ওই গাছে বা বাগানে লিচুর যেমন বাম্পার ফলনের সম্ভবনা থাকে, তেমনি মৌ চাষিরা বেশি মধু সংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারে।

জেলার বিভিন্ন বাগান থেকে শতাধিক মৌ-চাষি প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মণ মধু সংগ্রহ করে বাজারজাত করছে। কাঠের তৈরি শত শত বিশেষ বাক্সের মাধ্যমে মৌ-চাষ মধু সংগ্রহ করা দৃশ্য দেখে এলাকাবাসীও উদগ্রীব হয়ে ছুটে আসছেন মধু কেনার জন্য লিচু বাগানে।

ক্রেতা আবুল হোসেন জানান, বাজারে খাঁটি মধু পাওয়া যায় না। তাই নিজের চোখে নির্ভেজাল মধু সংগ্রহ করতে পেরে তারা নিজেকে ধন্য মনে করছেন।

কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, চলতি বছর প্রতিটি লিচু বাগানে ভালো মুকুল এসেছে। আর এ কারণে প্রচুর মৌ মাছির আগমন দেখা দিয়েছে। লিচু গাছ থেকে মৌ মাছি মধু আহরণের ফলে গাছে গাছে বেশি করে পরাগায়ন হয় এবং শতকরা ৩০-৪০ ভাগ লিচুর বেশি ফলন হয়।

লিচু বাগানে মৌমাছিদের গুনগুন শব্দে মুখরিত পুরো এলাকা। তবে কোন বন্য মৌমাছি নয়, বাক্সে চাষ করা শিকারী মৌমাছিই এমন গুঞ্জনে মুখরিত করছে। চলতি মৌসুমে এই অঞ্চলে লিচুর মুকুলের ওপর নির্ভর করে মৌয়ালরা এসেছে বিভিন্ন জেলা থেকে। সাথে নিয়ে এসেছে লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে বিরল প্রজাতির রাণী মৌমাছি। মৌয়ালরা নিজেদের সুবিধামত আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন এলাকার লিচু বাগানে। সেখানে দিনরাত পরিশ্রম করে মধু সংগ্রহ করছে।

সরেজমিনে বিরল উপজেলার চেতরা বাজার গেলে চোখে পড়ে মধু সংগ্রহের বাস্তব চিত্র। সেখানে ১০/১৫ জন মৌয়াল বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউবা মুখোশ পরে পুরনো বাক্স থেকে মৌচাক বের করে মধু সংগ্রহের জন্য প্রস্তত করছে। আবার কেউ পুরনো বাক্স বদলিয়ে নতুন বাক্সে মাছিদের জন্য নিরাপদ আবাস্থল তৈরি করছে। মৌয়ালদের মত কর্মী মাছিরাও বসে নেই। মৌমাছিরা দলবেধে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বাক্সের চাকে জমিয়ে রাখতে ব্যস্ত রয়েছে। সেখানে মৌমাছি ও মৌয়ালদের কর্ম ব্যস্ততায় উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে মধু মৌসুম।

এ বিষয়ে কথা হয় সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মৌয়াল চান মিয়ার সাথে। তিনি জানান, এই লিচু বাগানে মৌমাছির বাক্স রয়েছে আড়াইশ। এখানে ৭-১০ দিনের মধ্যে বাক্সগুলো থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়। এই মধু সংগ্রহ অভিযান চলবে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। প্রতি সপ্তাতে প্রায় ১২শ মনেরও বেশি মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। তবে ফুলের ওপর নির্ভর করে মধুর পরিমাণ।

তিনি আরো জানান, চলতি মৌসুমে এই বাগান থেকে ৫৫ মণ মধু সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। প্রতি মন মধুর বিক্রি করা হয় সাড়ে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই মধু দেশের বিভিন্ন কোম্পানির চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ভারতীয় কোস্পানি সস্তা দামে মধু ক্রয় করে বিদেশে রফতানি করছে। অথচ মধু কিনে নিচ্ছে আমাদের নিকট থেকে। এছাড়াও এই পেশার সঙ্গে যুব সমাজের একটি বড় অবদান রয়েছে। সরকারিভাবে কোন পৃষ্টপোষকতা না থাকায় সম্ভাবনাময় এই মধু চাষ শিল্পের কোন অগ্রসর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মধু চাষে সরকারি পৃষ্টপোষকতা থাকলে এই শিল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব। তেমনি দূর হতো বেকারত্ব সমস্যা।

লিচু এবং মধু দু’টি প্রাকৃতিক সম্পদ-এ দু’টি সম্পদ সংগ্রহ সঠিক প্রশিক্ষণ ও বাজারজাত করণে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হলে চাষিরা যেমন লাভবান হবে তেমনি দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে মনে করছেন দিনাজপুরবাসী।

Rafid

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন