দীর্ঘকাল ধরে গোলাপগঞ্জ উপজেলার মানুষ কৃষিনির্ভর। কৃষিকাজের মাধ্যমে নিজেদের স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই। এরকমই একজন সফল কৃষক হলেন উত্তর কানিশাইল (নওয়াইর ঘাট) গ্রামের কুশিয়ারা পাড়ের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান।
কৃষিজমি বর্গা নিয়ে ও উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ ক্রমে অল্প দিনেই সবজি ও ধান আবাদ করে বাজিমাত করেছেন তিনি। তার সাথে আলাপ করে জানা যায়, ২০১৬সালের মাঝামাঝিতে নিজস্ব জমি না থাকায় জমি বর্গা নিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ শুরু করেন। তারপর নিজের একাগ্রতা ও দৃঢ়চেতা মনোবলের দরুণ স্বল্প সময়ে সফলতা আশায় এখন তিনি নিজেকে একজন সফল কৃষকই মনে করছেন।
তাকে এলাকার অনেকেই কৃষিকাজে মনোনীবিশের জন্য আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে করছেন। তবে তার এ সফল কৃষক হয়ে উঠার পেছনের গল্প সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। কৃষক হাফিজুর রহমানের সাথে প্রতিবেদকের আলাপকালে উঠে আসে তার জীবনের নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের কথা।
তিনি জানান, অল্প বয়সে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার পিতা মোঃ হাবিবুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়লে সংসারে টানপোড়ন দেখা দেয়। তাই লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকলেও এসব কারণে লেখাপড়ার গন্ডি আলিয়া মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণীতেই থমকে যায়। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সংসারের হাল ধরতে হয় থাকে। তখন বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে কাঠমিস্ত্রির কাজে যোগ দেন। সেখানে ৬মাস থাকার পর সুবিধে না করতে না পেরে যোগ দেন রাজমিস্ত্রির কাজে।
রাজমিস্ত্রী হিসেবে বছর পাঁচেক কাজ করার পর একটি কাজে লোকসান দেখা দিলে ঢাকাদক্ষিণ বাজারে একটি পানের অস্থায়ী দোকান নিয়ে বসেন। সেখান থেকে অল্প অল্প পুঁজি সঞ্চয় করতে থাকেন। ২০০২সালের দিকে সরকারি উচ্ছেদ অভিযানে তার দোকানটি ভাঙা পড়লে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইতে। সেখানেও সুবিধে না করতে পারায় ৮মাস পর আবারও দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে অটোরিক্সা চালানো শুরু করেন। বেশ কয়েকবছর এ পেশা চালিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীরে ডায়বেটিস রোগ ধরা পড়ে। তারপর স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধের পাশাপাশি প্রতিদিন সকালে বাড়ির সম্মুখের স্বল্প জমি বর্গা নিয়ে সবজি চাষ শুরু করেন। অল্প দিনেই সবজি চাষে লাভ আসতে থাকলে এবং সেই সাথে নিজের ডায়বেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করলে তিনি কৃষিতে ঝুঁকে পড়েন।
তখন নিজের অটোরিক্সা বিক্রি করে পুরোদমে কৃষিকাজে নেমে পড়েন। তার পরে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি হাফিজুরকে। বর্তমানে তিনি জানান গত বছর ও চলতি বছরে আউশ ও আমন ধান ৩০ কেদার জমিতে আবাদ করেছেন। চলতি আমন মৌসুমে সে জমি থেকে ২২৪মন ধান পেয়েছেন। পাশাপাশি দেড় লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৬০শতক জায়গায় এ বছর সীম চাষ করেছেন।
ইতিমধ্যে অর্ধলক্ষাধিক টাকার সীম বিক্রি করেছেন। এছাড়াও চলতি রবি মৌসুমে শীতকালীন সবজির মধ্যে ৩০শতক জায়গায় ঝিঙ্গা, ১৫শতক জায়গায় মুলা, ৬০শতক জমিতে সরিষা, ২০শতক জমিতে টমেটো, ১৫শতক জমিতে চিচিঙ্গা, ২০শতক জমিতে শসা, ১৫শতক জমিতে করলা, ৩০শতক জমিতে ফরাস, ১৫শতক জমিতে ওলকপি এবং ১৫শতক জমিতে মিষ্টি লাউয়ের চাষ করেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ সবজিই বাজারে বিক্রি শুরু করছেন।
নয় সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন সুখেই দিনযাপন করছেন জানিয়ে হাফিজুর বলেন কৃষিকাজ করে নিজে পড়ালেখা করতে না পারলেও ছেলেমেয়েদের এখন পড়াচ্ছি। নিজের টাকায় বসতঘর বানিয়েছি। পাশাপাশি বাড়িতে ডিজেল চালিত একটি রাইসমিলও আমার আছে। গরুর বদলে পাওয়ার ট্রিলার দিয়ে জমিতে হালচাষ করছি। পাশাপাশি সরকারি অনুদানে একটি মাড়াইকলও পেয়েছি ।
এত সফলতার পরও আক্ষেপও ঝরে পড়ল তার মুখ থেকে, নিজস্ব কোন জায়গা জমি না থাকায় তেমন একটা টাকা সঞ্চয় করতে পারছেন না বলে তিনি জানান। যা আর্থিক লাভ হচ্ছে তার সিংহভাগ কৃষি সম্প্রসারণে ব্যয় করে দিচ্ছেন। বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় জীবন যাত্রার মান বেড়ে গিয়েছে বলে তিনি জানান। তবে সরকারি সহযোগীতা আরেকটু পেলে ভবিষ্যতে আরও বেশি সফল হবেন বলে তিনি আশাবাদী।
সবমিলিয়ে তিনি নিজেকে সফল এবং সাবলম্বী হিসেবেই মনে করছেন। যার স্বীকৃতিস্বরুপ ইতিমধ্যেই একাধিকবার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খায়রুল আমিনের সাথে আলাপ হলে তিনি জানান, হাফিজুর রহমান একজন আদর্শ কৃষক। তার সফলতা থেকে অন্যরাও অনুপ্রেরণা নিতে পারে। উপজেলা কৃষি অফিস এরকম কৃষকের পাশে সবসময় আছে। তিনি ইতিমধ্যে আমাদের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি সরকারি অনুদান থেকে তাকে মাড়াই কলও প্রদান করা হয়েছে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ