দুই দিনব্যাপী ১১তম আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি সেমিনার-২০১৯ এর উদ্বোধন

350

[metaslider id=”13580″]

স্বাস্থ্যকর জাতি গঠনে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের মানসস্মত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। যেহেতু গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, সেহেতু গবেষণা বৃদ্ধি এবং বায়োসিকিউরিটি বাড়িয়ে মানসম্মত উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, একই সাথে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে।

‘পোল্ট্রি ফর হেলথ লিভিং’ স্লোগানকে সামনে রেখে দু’দিনব্যাপী ১১তম আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি সেমিনার-২০১৯ এর উদ্বোধনী দিনে বক্তারা এসব কথা বলেন।

রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে মঙ্গলবার সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিনেই বিশ্বের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পোল্ট্রি গবেষকরা তাদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি) এ সেমিনারের আয়োজন করে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, ওয়াল্ড পোল্ট্রি এসোসিয়েশনে-বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ, সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুব হোসেন, ওয়াল্ড পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি নিং ইয়ং এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেফর মো. রফিকুল ইসলাম।

ওয়াপসা-বিবি’র সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, “আমরা যেসব খাবার খাই এবং সেগুলো যে ধরনের পুষ্টির যোগান দেয় তা আমাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ যেহেতু ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হতে যাচ্ছে, সেজন্য স্বাস্থ্যবান জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে টেকসই এবং সমতাভিত্তিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটি আর্থ-সামাজিক মডেল প্রয়োজন। ওই মডেলে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্রতামুক্ত সুস্থ নাগরিক এবং কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা দরকার। আমরা বিশ্বাস করি এগুলোর ভাল সমাধান দিতে পারে পোল্ট্রি শিল্প কারণ মানসম্পন্ন পুষ্টি সরবরাহে বড় অবদান রাখছে পোল্ট্রি খাত।

ওয়াপসা-বিবি’র সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুব হোসেন সেমিনারে দেশি ও বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানান।

ওয়াপসা’র গ্লোবাল সাধারণ সম্পাদক রোমেল মুলডার প্রতি চার বছর পর পর ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশসহ ওয়াপসার বর্তমান শাখা ৭০টি এবং মোট সদস্য সংখ্যা ৭ হাজার ৮০০ জন- যার মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৮০০ এর বেশি সদস্য নিয়ে ওয়াপসা’র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে।”

সেমিনারে ‘ব্রিডিং স্ট্রাটেজিক ফর ব্রয়লারস এন্ড লেয়ার আন্ডার সিফটিং প্যারাডাইমস’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভেনকাটেস ওয়ারা রিসার্স এন্ড ব্রিডিং ফার্মস প্রাইভেট লিমিটেডের জেনেটিক রিসার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট গবেষক জি.আই. জিম।

তিনি বলেন, “পোল্ট্রির লেয়ার ও ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানসম্মত প্যারেন্ট স্টাক বা গ্রান্ড প্যারেন্ট স্টক পালনের কোন বিকল্প নেই। কৌলিতত্ত্ববিদেরা বা জেনেটিসিস্টগণ পোল্ট্রির জাত উদ্ভাবনের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এদের সামনে দুটো বড় চ্যালেঞ্জ হলো পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য ব্রিডিং গোল নির্ধারণ করা ও ব্রিডিং ভেল্যু নির্ণয় করার মাধ্যমে উন্নত মানের জাত উদ্ভাবন করা। পাশাশি বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লারের বাচ্চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুনগত মানের হ্যাচারি স্থাপন অপরিহার্য। এমন একটি সফল ও স্বীকৃত হ্যাচারি ভারতে অবস্থিত, যার নাম ভেনকাটেস ওয়ারা হ্যাচারি। এটি প্রায় ৩৯ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
পৃথিবীব্যাপী পোল্ট্রি উৎপাদনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অধিক খাদ্য ব্যয়, পরিবেশগত প্রভাব, এ্যানিমেল ওয়েল ফেয়ার, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং রোগব্যাধী অন্যতম বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সেমিনারে ‘জেনেটিক ইমপ্রুভমেন্ট অব ব্রয়লার চিকেনস: সাকসেস স্টোরি অব ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আমেরিকার কব-ভেনটারেস কোম্পানির ডিপার্টমেন্ট অব রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট গবেষষক ফ্রাঙ্ক সাউয়িয়ার্ডট এবং এ্যানুওলুয়াপো ফ্রাঙ্ক।

তারা বলেন, ১৯৫০ সালের দিকে ইউএসএ-তে প্রায় ১০০টি কোম্পানি ব্রয়লার ব্রিডিং স্টক সরবরাহ করে আসছিল। মাত্র ৩৪ বছরের ব্যবধানে ওই কোম্পানির সংখ্যা ১শটি হতে ১৯৮৪ সালে মাত্র ২৮টিতে নেমে আসে। বর্তমানে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি ব্রিডিং কোম্পানি বিশ্বব্যাপী ব্রয়লার বাচ্চার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। গবেষক ও জেনেসিস্টদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পোল্ট্রি জার্মপ্লাজমের উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়টি সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

পরবর্তীতে ‘ওয়াটার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট মিটিগেট দ্য রিস্ক’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মিলিন্ড লাইমি। তিনি বলেন, “পুষ্টির উপাদানগুলোর মধ্যে পানি অন্যতম এবং সহজলভ্য একটি উপাদান। মানুষের যেমন বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজন হয় ঠিক একইভাবে পোল্ট্রির ক্ষেত্রেও বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন। পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং সরবরাহের ওপর নির্ভর করে পোল্ট্রি খামারের লাভ-ক্ষতি। বৃহৎ আকারের ক্ষেত্রে তাই গুণগত মানের পানি সরবরাহ করা একটি অপরিহার্য বিষয়। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা এখন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছে।”

সেমিনারে ‘ইমারজেন্স অব এশিয়ান ফুড বাসকেট অপারট্যুনেটিস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপন্থাপন করেন ভারতের হুভে ফার্মা সিইএ (পুনে) ও.পি সিং। তিনি বলেন, ‘ভারতে প্রায় ১২৩ কোটি মানুষ বাস করে এবং এর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যার মধ্যে এশিয়াতে আগামী ২০৩০ সালে মধ্যবিত্ত লোকের সংখ্যা প্রায় ৬৬ শতাংশ হবে। এই বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টি এবং খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। দ্রুত বর্ধনশীল পোল্ট্রি উৎপাদনের মাধ্যমে এই বর্ধিত জনসংখ্যার পুষ্টির চাহিদা যোগান দেয়ার সুযোগ রয়েছে। ভারতে পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ ১৪ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ইউরো এবং ব্রয়লার উৎপাদনের পরিমাণ ২০১৫-১৬ সালে ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন টন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় পোল্ট্রি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমানে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খাদ্যের গুণাগুণ ও পুষ্টি মান, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার সংকট, আধুনিক ভ্যালু এডেড পণ্য উৎপাদন, বায়োসিকিউরিটি এবং সাধারণ জনগণের সচেতনতাবোধ ইত্যাদি।

দুপুরে সাংবদিকদের জন্য আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ওয়াপসা-বিবি’র সভাপতি বলেন, বাংলাদেশে মাংসের কনজাম্পশন ১০ কেজির ওপরে সেখানে মুরগির মাংসের কনজাম্পশন প্রায় সাড়ে ৬ কেজি। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ফিডের এফ.সি.আর পৃথিবীতে খুব কম দেশেই আছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে আমাদের ফিডে যে সকল উপকরণ ব্যবহার করা হয় বেশ ভালোমানের।”

তিনি বলেন, “ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেন খামারিরা এন্টিবায়োটিক কিনতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে তার উন্নয়ন ঘটাতে হলে পোল্ট্রি শিল্পকেই গুরুত্ব দিতে হবে। পোল্ট্রি বীমা চালু হলে গ্রামের সাধারণ খামারিরাও ব্যাংক ঋণের সুবিধা পাবে বলে মন্তব্য করেন জনাব খালেদ।

কব ভেনট্রেস ইন্টা. ইউ.এস.এ -এর বিজ্ঞানী ড. ফ্রাঙ্ক এবং ভেংকটেসওয়ারা রিসার্চ অ্যান্ড ব্রিডিং ফার্মস এর জি.এল জেইন বলেন, ‘‘জি.এম.ও মুরগি বলে কিছু নেই। পোল্ট্রিতে আজকের এই অগ্রগতি অনেক কস্টের ফসল। এটি অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া। বহু বছরের সাধনার পর এ অগ্রগতি এসেছে।”

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন