দুধ উৎপাদনকারী বাংলাদেশের প্রান্তিক খামারিরা বছরের পর বছর লোকসান গুনছেন, অন্যদিকে তাদের দুধ কিনে কোম্পানিরা লাভবান হচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বার্ষিক কিছু আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কোনো সক্রিয় কার্যক্রম দেখেন না খামারিরা। এমনটাই অভিযোগ প্রান্তিক খামারিদের।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদন বাড়ার তথ্য সরকার দিলেও খামার পর্যায়ে দুধ সংগ্রহ ও বিক্রয়-উপযোগী বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারেনি। খামারিদের বাধ্যতামূলকভাবে দুধ বিক্রি করতে হয়। উৎপাদিত দুধ বিক্রি না হলে এলাকাভিত্তিক কোনো ফ্রিজিং ব্যবস্থাপনাও করা হয়নি সরকারের উদ্যোগে। ফলে প্রতিদিনের উৎপাদিত দুধ প্রতিদিন স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
খামারিদের অভিযোগ, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলো তাদের কাছ থেকে এক লিটার তরল দুধ বোনাসসহ ৪৩ টাকায় কিনে প্যাকেটজাত করে প্রতি লিটার ৯০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এক লিটার তরল দুধ থেকে আবার ৬০ টাকার ঘি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে এসব দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রতি লিটার দুধে আয় করছে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটার দুধে তাদের লাভ থাকছে ৯২ টাকার বেশি। দীর্ঘদিন ধরে দুগ্ধজাত কোম্পানিগুলো খামারিদের কাছ থেকে পানির দরে দুধ কিনে ব্যবসায়িকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন। অথচ লোকসান গুনছেন খামারিরা।
দেশে ২০১৮ সালে এক লিটার পাস্তুরিত তরল দুধের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। ২০২১ সালেও দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এখন দাম ৯০ টাকা। পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিকেই দুধের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে দুধ উৎপাদন হতো প্রায় ৫০ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। পরের তিন অর্থবছরে তা বেড়ে ৭২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি হয়। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন এক লাফে ২০ লাখ মেট্রিক টন বেড়ে হয় ৯২ লাখ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল এক কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। তবে এতে দেশে দুধের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। কারণ দেশে বছরে চাহিদা এক কোটি ৫৬ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা দরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে দিনে মাথাপিছু দুধ উৎপাদিত হয় ২০৮ মিলিলিটার। দুই বছর আগে এই পরিমাণ ছিল ১৭৫ মিলিলিটার। তবে বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক সংগতি সেভাবে না থাকায় মফস্বল পর্যায়ে দুধ পানের পরিমাণ অনেকাংশে কম। এতে স্বাস্থ্য ভঙ্গুর ও পুষ্টিহীন সন্তান জš§দানের বিষয়টি প্রকট। অথচ প্যাকেটজাত দুধের দামের তুলনায় তরল দুধের দাম খুবই সহজলভ্য।
বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন জানান, খামার পর্যায়ে পরিবহন খরচসহ ৫৫ টাকা ৩০ পয়সা টাকা লিটারে দুধ কিনছেন। অন্যান্য কোম্পানি কিনছেন ৪৭ টাকায়। বিনা মূল্যে ঘাসের বীজ, চিকিৎসকের খরচ, কোনো খামারি ১০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করলে প্রতি লিটার এক টাকা বাড়তিসহ নানা প্রণোদনা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ এলাকার বিভিন্ন প্রান্তিক খামারিরা জানান, রমজানের পর দুধের দাম কোথাও কোথাও ২৫ টাকায় নেমেছে। সর্বোচ্চ ৫০ টাকা দরে দুধ বিক্রি করে গরুর খাবারের দাম হচ্ছে না। খৈল, ভুসি, ধানের কুঁড়ো, খুদ সবকিছুর দাম কেজিতে কমপক্ষে ২০ টাকা বেড়েছে, সেই তুলনায় দুধের দাম বাড়েনি। ফলে পাঁচ বছর আগের দামেই দুধ বিক্রি করছেন খামারিরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার পরিচালক মোছা. জিনাত আরা বলেন, আপাতত আমাদের খামারিরা খুব বিপদে আছেন। আমরা কিছু করতে পারছি না। কারণ দুধ বিপণনের জন্য আমাদের প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে আগামীতে খামারিদের জন্য সুখবর আছে। দেশের ৫৫ হাজার পিজি গ্রুপ ডেইরি হাবের তালিকায় আসবেন। দেশের সব শহরে ও জেলায় ডেইরি হাব হবে। সেখানে দুধের পাস্তুরাইজেশন হবে এবং সরকার সংগ্রহ করবে। দুধের দাম নির্দিষ্ট করে দিলে খামারিরা লোকসান দেবেন না, বরং উপকৃত হবেন।