দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট’সহ ১০ জেলার উপজেলায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও হাসি নেই কৃষকের মুখে। কাঙ্খিত ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে এখন বিভোর কৃষক।এখানে বর্তমানে দেড় মন ধানের টাকায়ও একজন কাঙ্খিত শ্রমিক মিলছে না।যে ধানকে ঘিরে কৃষকের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও আশা। সেই মাঠ ভরা ধানই এখন তাদের ঘাড়ের বোঝা হয়ে দাঁড়িছে।
শুক্রবার দুপুরে এমনটাই জানিয়েছেন এ উপজেলার বেশ কয়েকজন ধান চাষি। কুরমনি গ্রামের ধান চাষি খোকন রানা, রঞ্জন বসু, মুন্না শেখ, সুধাংশু মন্ডল, সুমন ফরাজী, পাটরপাড়ার ইউনুস বিশ্বাস, শ্রীরামপুরের তাপস ভক্ত ও ডুমুরিয়ার বিপ্লব বাড়ৈসহ অনেক কৃষক জানান, এ উপজেলায় এখন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ভরা মৌসুম চলছে। প্রতিবছর বিভিন্ন অঞ্চলের পরবাসি দাদারা (ধান কাটা শ্রমিক) দলবেধে এসে ধান কেটে মাড়াই ও ঝেড়ে শুকনা করে গোলায় ভরে দিয়ে যেত। কিন্তু এবার করোনার কারণে তারা কিছুতেই আসতে রাজি হচ্ছেন না। তাই মাঠের পাকা বোরো ধান নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন। অন্যদিকে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টির দাপটে ক্ষেতের ধান ঝরে ও পানিতে পড়ে তারা চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। তবুও কাঙ্খিত ধান কাটা শ্রমিক মিলছে না।তারা গ্লানি ভরা কণ্ঠে আরও জানান, এখানে বর্তমানে প্রতিমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৬৪০ টাকা দরে। অথচ একজন ধান কাটায় অযোগ্য শ্রমিকেরও মুজুরি দিতে হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকা। সাথে দুই বেলার খাবার। কাজ করে সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত। তাতে কৃষকের চরম লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই মাঠ ভরা পাকা ধানই এখন তাদের ঘাড়ের বোঝা হয়ে দাঁড়িছে।
অপরদিকে, খড়মখালি গ্রামের ধান চাষি পরিমল মজুমদার, কংকন মজুমদার, মনিমহোন হীরা, অসীম বিশ্বাস, কৃষ্ণ রানাসহ অনেকে বলেন, ধানের দাম আছে ৬০০ টাকা মন। আর শ্রমিক আনতে গেলে কেউ ৯০০ টাকার কমে কাজে আসতে চায় না। এবার ধান চাষ করতে আমাদের একর প্রতি খরচ আছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। খুব ভালো ফলন হলে প্রতি একর জমিতে ৭৫ থেকে ৮০ মন ধান উৎপাদন হয়। হাজার টাকার কমে ধানের মন বিক্রি করলে চালান উঠবেনা।
কৃষি বিভাগ বলছে, বাগেরহাটে এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। করোনার প্রভাবে শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উপর নির্ভর করতে হবে। ইতিমধ্যে ভর্তুকি মূল্যে কিছু রিপার (ধান কাটার যন্ত্র) বিতরণ করা হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে মতে, বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলায় এবছর ৫২ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সদর উপজেলায় ৯ হাজার ৫০ হেক্টর, ফকিরহাটে ৮ হাজার ২০০ হেক্টর, মোল্লাহাটে ৮ হাজার ৩২০ হেক্টর, রামপালে ৪ হাজার ৭৫ হেক্টর, কচুয়ায় ৬ হাজার ৭০০ হেক্টর, মোরেলগঞ্জে ৫ হাজার২০ হেক্টর, চিতলমারী ১১ হাজার ৪৭০ হেক্টর, শরণখোলা ৮৫ হেক্টর, মোংলায় ৫ হেক্টর জমিতে ফসক। এর মধ্যে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রীড) এবং বাকী জমিতে স্থানীয় জাতের ধানের চাষ হয়েছে। এবছর ২ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিকটন বোরোর আবাদ হবে বলে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দশ জেলায় ৬ লাখ ৮২ হাজার ৯৩৭ হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জেলাওয়ারী রোপা ধান চাষ ও উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা হচ্ছে- যশোর জেলায় ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে ৩,৫২,৫৩৭ মেট্রিক টন, নড়াইল জেলায় ৩০ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে ৭৫ হাজার ৬৩৩ মেট্রিক টন, ঝিনাইদহ জেলায় ৮৭ হাজার ৯২ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৭৩ মেট্রিক টন, মাগুরা জেলায় ৫০ হাজার ২২৬ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৬৪ মেট্রিক টন, কুষ্টিয়া জেলায় ৭৫ হাজার ৪৩ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৩২ হাজার ৯০ মেট্রিক টন, মেহেরপুর জেলায় ২৩ হাজার ৮০৪ হেক্টর জমিতে ৬৪ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪২ হাজার ৩৯১ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৭৮ মেট্রিক টন, সাতীরা জেলায় ৯৮ হাজার ৯৯৩ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৭৩৯ মেট্রিক টন, খুলনা জেলায় ৭৫ হাজার ৩৫৪ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন এবং এবছর ২ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিকটন বোরোর আবাদ হবে বলে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আবাদ কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছেন। কৃষি ব্যাংকসহ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক আবাদ কার্যক্রম সফল করতে কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় লোনের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
বোরোর এই বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি ফুটলেও দেখা দিচ্ছে শ্রমিক সংকট। আকাশে একটু মেঘ দেখলেই চাষীদের চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। কিভাবে তারা সোনার ফসল ঘরে তুলবে।
চিতলমারী উপজেলা কৃষি কর্মকতা ঋতুরাজ সরকার মুঠোফোনে বলেন, এ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ২১ টি ব্লক রয়েছে। এখানে এ বছর প্রায় ৩০ হাজার একর জমিতে বেরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের ফলন হয়েছে বাম্পার। কমপক্ষে ২৫-৩০ হাজার কৃষক পরিবার এই বোরো ধানের চাষের সাথে জড়িত। এখানে এ বছর ৮০ হাজার মেট্রিকটন ধান কৃষকের ঘরে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু করোনার কারণে এবার অনেক চাষিই করোনার ভয়ে বাইরের ধানকাটা শ্রমিক আনতে রাজি না। আবার অনেক শ্রমিক আবার আসতে রাজি না। যার কারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৯মে২০