দেশীয় পদ্ধতিতে সবুজ ঘাস সংরক্ষণ

1395

ভূমিকা
বাংলাদেশে বৃষ্টির মৌসুমে কোনো কোনো এলাকায় প্রচুর পরিমাণে ঘাস পাওয়া যায়। যেমন- দুর্বা,বাকসা,আরাইল,সেচি, দল, শস্য খেতের আগাছা ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন গাছের পাতা যা গো- খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়, যেমনঃ ইপিল-ইপিল , ধইঞ্চা ইত্যাদি। বৃষ্টির মৌসুমে গো- সম্পদেও স্বাস্থ্যের যথেষ্ট উন্নতিও হয়।

শুষ্ক মৌসুমে সবুজ ঘাসের অভাবে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। দেশীয় এ সবুজ ঘাস অথবা জমিতে চাষ করা নেপিয়ার, পারা, ভূট্টা, সরগম, ওট ইত্যাদি খুব সহজেই “সাইলেজ” করে সংরক্ষণ করা যায়। “সইলেজ” ইংরেজি শব্দ যা দ্বারা গো-খাদ্যের বেলায় সবুজ ঘাসের পুষ্টিমান অক্ষুন্ন রেখে একটি নির্দিষ্ট অম্লতায় বা ক্ষারত্বে সংরক্ষিত ঘাসকে বুঝায়। সাধারণত খড় জাতীয় খাদ্য ব্যতীত সব ধরনের সবুজ ঘাসই অম্লতায় সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণের পর বছরের যে কোনো সময় সংরক্ষিত ঘাস তুলে সরাসরি গরুকে খাওয়ানো যায়।

সবুজ ঘাসের সাইলেজ করতে সাইলো ( যেখানে সাইলেজ রাখা হয় ) ও প্রিজারভেটিভ ( যা ঘাসকে সংরক্ষণ করে ) দরকার হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকারের পাকা সাইলোর ব্যবহার হয়ে থাকে। এমনকি ঘাসকে মেশিন দ্বারা পলিথিনে মুড়েও সাইলেজ তৈরি করা হয়। আমাদের দেশে কৃষক পর্যায়ে এ সমস্ত পদ্ধতিতে ঘাস সংরক্ষণ সম্ভব নয় । এজন্য বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট স্বল্প ব্যয়ে মাটির গর্তে সবুজ ঘাস সংরক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে।

ঘাস সংরক্ষণের প্রিজারভেটিভ হিসেবে বাংলাদেশে সহজলভ্য চিটাগুড় ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রাপ্ত সবুজ ঘাসে প্রচুর পরিমাণে জলীয়াংশ থাকে। এ জন্য এ ধরনের ঘাসের সাইলেজ তেমন ভালো হয় না। তবে এ সমস্ত সবুজ ঘাসের সঙ্গে শতকরা ১৫ – ২০ ভাগ শুকনো খড়ের স্তর দিলে এক দিকে সাইলেজের গুণাগুণ ভালো থাকে অন্যদিকে সাইলেজের নির্যাস চুঁইয়ে খড়ের খাদ্যমানও বৃদ্ধি করে। এতে একটা বাড়তি সুবিধা হলো পরিবর্তে শুকনো খড় আলাদা করে আর খাওয়ানো লাগে না। খড়ের অভাব থাকলে খড় না দিলেও সাইলেজ করা যাবে।

ডাল বা লিগুম জাতীয় ঘাস যেমন : খেসারি, মাষকলাই,কাউপি বা হেলেন ডাল, ইপিল ইপিল ইত্যাদি ঘাসও সবুজ অবস্থায় সাইলেজ করে রাখা যায়। এ ধরনের ঘাসে অধিক পরিমাণে প্রোটিন বা আমিষ থাকে বিধায় শুধুমাত্র ডাল জাতীয় ঘাস দ্বারা সাইলেজ করলে ভালো সাইলেজ নাও হতে পারে। এজন্য এ ধরনের ঘাস অডাল বা নন-লিগুম জাতীয় ঘাসের ( ভূট্রা, নেপিয়ার ইত্যদি ) সাথে সর্বোচ্চ ১:১ এবং সর্বনিম্ন ১:৩ অনুপাতে মিশিয়ে চিটাগুড় দিয়ে সাইলেজ করা ভালো।

মিশ্রিত ঘাসের পরতে পরতে আগের নিয়মে খড় দেয়া ভালো। নন- লিগুম জাতীয় ঘাস না পাওয়া গেলে শুকনা খড়ের সাথে মিশিয়ে ও সাইলেজ তৈরি করা যায় । পূর্বের নিয়মেই ঘাসের সাথে খড় ব্যবহার করা যাবে।

মাটির গর্ত:-
একশ সিএফটি একটি মাটির গর্তে ২.৫০ থেকে ৩.০০ টন সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করা যায়। গর্তটি অবশ্যই উঁচু জায়গায় ( যেখানে পানি মোটেই গর্তে ঢুকতে পারবে না ) হতে হবে। গর্তের গভীরতা ৩ ফুট, প্রস্থের তলায় ৩ ফুট, মাঝে ৮ ফুট ও ওপরে ১০ ফুট হবে। দৈর্ঘ্যের মাপ নির্ভর করবে ঘাসের পরিমাণের ওপর। গর্তটির তলা পাতিলের মতো সমভাবে বক্র থাকলে ঘাস চাপানো সহজ হবে।

পলিথিন:-
মাটির সাইলোর চারদিকে পলিথিন মুড়ে সাইলেজ করলে অবশ্যই ঘাস নিশ্চিন্তে রাখা যায়। কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার ঘাসের সংরক্ষণ খরচ বাড়িয়ে দেয় এজন্য সাইলোর তলায় এবং চারদিকে শুকনো খড় দিয়ে মাটি ঢেকে রাখা যায়। দুই গজ চওড়া ডাবল পলিথিনের ৮-৯ গজ হলেই ২০ ফুটের একটি সাইলোর শুধু ওপরের দিক বন্ধ করা যায়। চারিদিকে মুড়লে পলিথিনের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

সাইলেজ তৈরী পদ্ধতি:-
সবুজ ঘাসের শতকরা ৩-৪ ভাগ চিটাগুড় মেপে একটি চাড়িতে নিতে হবে। তারপর ঘন চিটাগুড়ের মধ্যে ১:১ অথবা ৪ : ৩ পরিমাণে পানি মেশালে এটি ঘাসের ওপর ছিটানো উপযোগী হবে। ঝরণা বা হাত দ্বারা ছিটিয়ে এ মিশ্রণ ঘাসে সমভাবে মেশানো যাবে।

সাইলোর তলায় পলিথিন দিলে আগে বিছিয়ে নিতে হবে। পলিথিন না দিলে পুরু করে খড় বিছাতে হবে। এরপর দুইপার্শ্বে পলিথিন না দিলে ঘাস সাজানোর সাথে সাথে খড়ের আস্তরণ দিতে হবে । এরপর পরতে পরতে সবুজ ঘাস এবং শুকনো খড় দিতে হবে। প্রতি পরতে ৩০০ কেজি সবুজ ঘাস এবং ১৫ কেজি শুকনো খড় দিতে হবে।

৩০০ কেজি ঘাসের পরতে পূর্বেও হিসেবে ৯ থেকে ১২ কেজি চিটাগুড় ও ৮ থেকে ১০ কেজি পানির মিশ্রণ ঝরণা বা হাত দিয়ে সমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। খড়ের মধ্যে কোনো চিটাগুড় দিতে হবে না। এভাবে পরতে পরতে ঘাস ও খড় সাজাতে হবে এবং ভালোভাবে পারিয়ে ভেতরের বাতাস যথাসম্ভব বের করে দিতে হবে।

যত এঁটে ঘাস সাজানো হবে তত সুন্দর সাইলেজ তৈরি হবে। এভাবে সাইলো ভর্তি করে মাটির উপরে ৪-৫ ফুট পর্যন্ত ঘাস সাজাতে হবে। ঘাস সাজানো শেষ হলে খড় দ্বারা পুরু করে আস্তরণ দিয়ে সুন্দর করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

সর্বশেষে ৩-৪ ইঞ্চি পুরু করে মাটি দিতে হবে সম্পুর্ণ ঘাস এক দিনেই সাজানো যায়। তবে বৃষ্টি না থাকলে প্রতিদিন কিছু কিছু করেও কয়েক দিনব্যাপী সাইলেজ তৈরি করা যায়।

সাবধানতা:-
# নিচু জায়গায় সাইলো করা যাবে না । তাতে পানি জমে সাইলেজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে ,
# উপরের পলিথিন সুন্দর ভাবে এঁটে দিতে হবে যাতে কোনো পানি সাইলেজের ভেতরে প্রবেশ না করে।
# চিটাগুড় পাতলা হলে পরিমাণ বাড়িয়ে পানি কম করে মেশাতে হবে। বেশি পাতলা হলে ঘাস থেকে চুঁইয়ে নিচে চলে যাবে। এমনভাবে দ্রবণ তৈরি করতে হবে যাতে আঠার মতো ঘাসের গায়ে লেগে থাকে,
# ঘাস এবং খড় এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে ফাঁকা জায়গাগুলো যথাসম্ভব বন্ধ হয়ে যায়,
# সাইলোর কোনাগুলো এবং পাশ সমূহ পা দিয়ে পাড়িয়ে ঘাস সাজাতে হবে যাতে ফাঁকা বন্ধ হয়ে যায়,
# ঘাসের সাথে খুব বেশি পানি থাকা বাঞ্চনীয় নয়।

খাদ্য গ্রহণ:-
এভাবে সংরক্ষিত ঘাস প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ কেজি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। উক্ত বর্ণিত পদ্ধতিতে বর্ষা মৌসুমের প্রাপ্ত ঘাস সংরক্ষণ করলে শুষ্ক মৌসুমে গো- খাদ্যের অভাব হ্রাস করা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র: বিএলআরআই

ফার্মসএন্ডফার্মার/২১সেপ্টেম্বর২০