প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, ক্রমাগত পরিবেশদূষণ আর নির্বিচারে জলাশয় ভরাটে একদিকে যেমন সংকুচিত হয়ে আসছে দেশি মাছের আবাসভূমি, অন্যদিকে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্বিচারে ডিমওয়ালা মাছ ও রেণু পোনা নিধনে দেশি প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই নানা প্রজাতির দেশি মাছে সারা বছরই ভরপুর থাকে সাহিদুর রহমানের পুকুরগুলো। শুধু তা-ই নয়, প্রজননের সময় তাঁর পুকুরের মা-মাছগুলো ছড়িয়ে দেন নড়াইল জেলার অন্যতম বৃহৎ ইছামতী বিলে।
সাহিদুর রহমানের বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার নলদী ইউনিয়নের চরবালিদিয়া গ্রামে। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। বাড়ির পার্শ্ববর্তী ইছামতী বিলে শোল, মাগুর, শিং, টেংরা, পুঁটি, বাইন, টাকি, রয়না, পাবদা, ফলি, মায়াসহ নানা প্রজাতির দেশি মাছ চাষ করে তিনি পেয়েছেন ব্যাপক সাফল্য। তাঁকে অনুসরণ করে অন্তত ৫০ জন এসব মাছ চাষে সাফল্য পেয়েছেন।
ইছামতী বিলের নানা প্রজাতির দেশি মাছ একসময় বৃহত্তর যশোর জেলার মানুষের মাছের চাহিদার এক বড় অংশ জোগান দিত। সেই বিলকে দেশি মাছশূন্য দেখে এগুলো সংরক্ষণের ইচ্ছা জাগে সাহিদুরের। ১৯৯৫ সালে ইছামতী বিলে নিজের দেড় একর জমির ওপর একটি পুকুর দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। তখন একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিসূত্রে মাছ চাষে অভিজ্ঞতা হয়। ২০০৫ সালে চাকরি ছেড়ে দেন। এখন সাহিদুরের প্রায় ৬০ একর জায়গার ওপর পাঁচটি বড় পুকুর, সাতটি মাঝারি পুকুর এবং ১৬টি আফা (বিলের মধ্যে দেশি মাছ সংরক্ষণের ছোট আকৃতির পুকুর) রয়েছে।
লোহাগড়া উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ইছামতী বিল। বিলের মাঝখানে ‘মাছের ঘের’ বলে পরিচিত সাহিদুরের পুকুরগুলো। বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় এখানে মাছ বিক্রি হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে পুকুরের পাড়ে। চরবালিদিয়া গ্রামের মন্টু শেখ বলেন, ‘এলাকায় কাজের অভাব। এখন সাহিদুরের পুকুরের মাছ বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি।’ ইউছুফ শেখ জানালেন, আশপাশের কমপক্ষে ১১টি গ্রামের শতাধিক মানুষ এখন সাহিদুর ও তাঁর অনুসারীদের মাছ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। সাহিদুরের সাফল্য দেখে তাঁকে অনুসরণ করে দেশি মাছ চাষে এগিয়ে এসেছেন কমপক্ষে ৫০ জন। শামসুর রহমান বলেন, আগে ইছামতী বিলে অনেকেরই ছোটখাটো পুকুর ছিল, তা দিয়ে নিজেদের খাওয়া চলত। সাহিদুরকে দেখে এই বিলে কমপক্ষে ৫০ জন বাণিজ্যিকভাবে দেশি মাছ চাষ করছেন।
সাহিদুরের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, বছরে ১০-১২ লাখ টাকার দেশি মাছ বিক্রি হয়। চলতি বছর শুধু মাগুর মাছই বিক্রি করেছেন তিন লাখ টাকার। আর শোল, শিং, কই, টেংরা, পুঁটি, বাইন, টাকি, রয়না প্রভৃতি বিক্রি করেছেন সাত লাখ টাকার। দেশি মাছ চাষে খরচ কম, লাভ বেশি। এ ছাড়া বড় মাছের পোনাও বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে বছরে আয় করেন প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকা।
দেশি মাছের পোনা কিনে পুকুরে দিলে বা বিলের পোনা মাছ পুকুরে ঢুকিয়ে দিলেই এগুলো বড় হবে বা বংশবৃদ্ধি হবে—এমন ধারণা ঠিক নয়। এর জন্য চাই বিভিন্ন মাছের ভিন্ন পরিবেশ—এমন মন্তব্য করে সাহিদুর জানান, শিং মাছ ঘোলা পানিতে ডিম দেয়। পুঁটি মাছ পুকুরে ডিম দেয় না। খাল-বিলের স্রোতে ডিম দেয়। আবার কই মাছের ডিম থেকে পুকুরে বাচ্চা হয় কম। এর বাচ্চা হয় মুক্ত জলাশয়ে।
সাহিদুর জানালেন, বিভিন্ন দেশি মাছের পছন্দের খাবারের রকম ভিন্ন। পুঁটি মাছের খাবার গমের ভুসি। শোল মাছের খাবার পুঁটি মাছ। মাগুর ও শিং মাছের জন্য শুঁটকি মাছ, গমের ভুসি পচিয়ে পুকুরে বেঁধে দিতে হয়। কই মাছের জন্য ভাত, নারকেলের খৈল, ভুসি, শুঁটকি মাছ পচিয়ে পুকুরে রাখতে হয়। টেংরা মাছের জন্য গম, সরিষা ও নারকেলের খৈল দিয়ে থাকেন পুকুরে।
আর এদের বসবাসের জন্য পছন্দের পালা পুকুরে রাখতে হয়। পালা হচ্ছে—বাবলা, হিজল ও সড়া গাছের ডাল। জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে মাছের পেটে ডিম আসে। মা-মাছ তৈরি হয়। তখন ১৬টি আফার পাড় কেটে নালা করে প্রজননের জন্য মা-মাছ ইছামতী বিলে ছেড়ে দেন। এ সময় আফা থেকে কোনো মাছ ধরেন না। পরে কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এই মাছ ধরে বিক্রি করা হয়। এর ফলে ইছামতী বিলেও এসব মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের যশোর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্ধতিটি যুগোপযোগী ও মৎস্য উৎপাদনের আধুনিক ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এ নিয়ে কিছু প্রায়োগিক গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন, যা পদ্ধতিটিকে আরও উন্নত করতে সহায়ক হবে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হোসনে আরা বলেন, ‘সৃষ্টিশীল উদ্যোগী মানুষ সাহিদুর। দেশি মাছ চাষে তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের কারণে ইছামতী বিলে দেশি মাছ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁর মতো মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এগিয়ে এলে আবার হয়তো দেশি মাছে ভরপুর হয়ে উঠবে আমাদের এই জন্মভূমি। ২০১০ সালে তিনি নড়াইল জেলায় শ্রেষ্ঠ মৎস্যচাষি নির্বাচিত হন।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মো. আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাছের উৎপাদন কেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না, নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে কি না, চাষ-পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব কি না—এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। যদি মাছের উৎপাদন এবং জীববৈচিত্র্য প্রতিবছরই বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, তবে সাহিদুরের এভাবে মাছ উৎপাদন-পদ্ধতিকে দেশে প্রচলিত মৎস্য অভয়াশ্রমেরই আরেকটি উন্নত সংস্করণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
আবদুল ওহাব আরও বলেন, মৎস্য অধিদপ্তরের সহায়তায় সাহিদুরের পদ্ধতির কিছুটা সংস্কার করে বাঁওড় ও বিল-অধ্যুষিত বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এলাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় যেখানে প্রাকৃতিক নিম্নাঞ্চল রয়েছে, সেখানে মৎস্য উৎপাদন করা যেতে পারে। এতে করে বিপুল মৎস্য উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ