বছরে ৯ হাজার কোটি টাকার রফতানি সম্ভাবনা
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান—এ তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত পাঁচ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি হিসেবে পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম আবাদ করলে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করা সম্ভব, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি পাহাড়ি জমিতে আবাদ করা যেতে পারে কফিও। আগামীতে এ দুটি ফসল হতে পারে দেশের অন্যতম রফতানি পণ্য। পাহাড়ি এলাকার পরিবারগুলোয় হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান। এ সম্ভাবনা নজরে এসেছে সরকারের। এ খাতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে অর্থ, পরিকল্পনা ও কৃষি মন্ত্রণালয়।
তিন পার্বত্য জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাজার কফি ও কাজুবাদামের বাগান করার সম্ভাবনার চিত্র সম্প্রতি সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ তানভীর। পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। কাজুবাদামের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে এ তিন মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করবে বলে জানান তারা। আগ্রহী কৃষকদের সরকারের পক্ষ থেকে কফি ও কাজুবাদাম উৎপাদন, চাষ পদ্ধতি, প্রক্রিয়াজাত ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলেও জানানো হয়।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সরকার কৃষি খাত এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। এক্ষেত্রে কাজুবাদাম অবশ্যই একটি সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। কাজুবাদাম রফতানি ও উৎপাদন কাজ এগিয়ে নিতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। আমার বিশ্বাস, কিছুটা সুবিধা দিলে কাজুবাদাম ব্যাপক সম্ভাবনাময় রফতানিযোগ্য কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারে জায়গা করে নিতে পারবে। বেশি পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে।
তিনি আরো বলেন, এক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা তুলে নেয়া হবে। আমি আমার ব্যবসার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যেকোনো ব্যবসার জন্য দেশী ও বিদেশী—দুই বাজারেই চাহিদা সৃষ্টি করতে হয়। এখন রফতানি আয় বাড়াতে হলে একই সঙ্গে চাষাবাদ বাড়ানো ও বাজারজাত করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারী আনতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারী আনতে না পারলে বৈশ্বিক বাজার ধরা কঠিন। এক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী যৌথ বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তরুণ উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ তানভীর চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ডেইলপাড়ায় ২০১৫ সালে দেশের প্রথম কাজুবাদামের কারখানা গ্রিনগ্রেইন ক্যাশিউ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছেন। সঙ্গে ছিলেন সহ-উদ্যোক্তা ইকরাম মোরশেদ। শুরুতে মাত্র ১০ জন কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। এখন কারখানায় কাজ করছেন ৬৫ জন। এর মধ্যে ৫৫ জনই নারী কর্মী। উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে এ সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিন এ কারখানা থেকে দেশের অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম। প্রতিষ্ঠানটি মধ্যপ্রাচ্যের বাজারেও কাজুবাদাম রফতানি করছে। সর্বশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ে সাড়ে ৩ হাজার কেজি কাজুবাদাম রফতানি করেছেন বলে জানান শাকিল আহমেদ তানভীর। রফতানি হওয়া এসব কাজুবাদামের বাজারমূল্য ২৩ হাজার ডলারের বেশি। দেশে কাজুবাদাম আমদানি হয় ভিয়েতনাম থেকে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত বছর ৫ লাখ ৮০ হাজার কেজি কাজুবাদাম আমদানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ৭০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে গ্রিনগ্রেইন ক্যাশিউ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল আহমেদ তানভীর বলেন, প্রক্রিয়াজাত কারখানা না থাকায় শুরুতে কাঁচা কাজুবাদাম রফতানি করা হতো। রফতানির পর বিদেশের কারখানায় প্রক্রিয়াজাত বাদাম আবার উচ্চমূল্যে আমদানি হতো। সেজন্য দেশেই কারখানা তৈরি ও বিদেশে রফতানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শুরুতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। এখন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শুল্ক ও নীতি সহায়তা দিলে আগামী দিনের বড় রফতানি খাত হবে কাজুবাদাম।
জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি পোশাক খাতের মতো সহায়তা দেয়া হলে কাজুবাদাম রফতানি করে ২০২৪ সালের মধ্যে বছরে ১০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব হবে। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে সীমিত আকারে কাজুবাদাম চাষ হচ্ছে। কৃৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা করতে পারলে এটি আরো বাড়ানো সম্ভব। কেননা এটি আবাদ, প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
বাংলাদেশে এখনো সেভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রক্রিয়াজাত যন্ত্রপাতি নেই, যাতে পোস্ট প্রসেসিংয়ের কাজ করা যায়। তাছাড়া সংরক্ষণ প্রক্রিয়াও কেউ ঠিকমতো জানত না। এটি এমন একটি ফল, যা কাঁচা বেশি খেতে পারবেন না। ফলটি হয় দুই স্তরে। উপরের অংশটুকু মোটা। নিচের অংশে বাদাম। এর ভেতরে এক ধরনের আঠাজাতীয় জিনিস থাকে। এটা মুখে বা হাতে লাগলে চর্মরোগ হতে পারে। আবার উপরের অংশটি প্রসেস করতে পারলে প্রচুুর ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া সম্ভব। এর পুষ্টিগুণও বেশ ভালো।
জানা গেছে, বর্তমানে সারা বিশ্বে ৩৫ লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরিকোস্ট, নাইজেরিয়া, ঘানা ও বেনিনে। এসব দেশে প্রায় ১২ লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। কিন্তু এ দেশগুলো কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করতে পারে না। এসব দেশ মাত্র ১০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করে। এসব দেশে উৎপাদিত কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে ভিয়েতনাম। যদিও দেশটি বছরে চার লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদন করে। অন্যদিকে ভারতে প্রতি বছর ৭ লাখ ৪৬ হাজার টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর সাকল্যে মাত্র এক হাজার টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। যদিও বাংলাদেশে পাঁচ লাখ হেক্টর কাজুবাদাম চাষ উপযোগী জমি রয়েছে। দুই হাজার হেক্টর জমিতে এখনই কাজুবাদামের চাষাবাদ শুরু করা যায়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশের কাজুবাদামের উৎপাদন পাঁচ লাখ টনে দাঁড়াবে। তবে এজন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকার এখন কৃষি ব্যবস্থাকে বহুমুখীকরণ করতে চায়। এজন্য উচ্চমূল্যের ফসল আবাদের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। উচ্চমূল্যের ফসলের মধ্যে কাজুবাদাম অত্যন্ত পুষ্টিকর ও মজাদার খাদ্য। এটি উত্কৃষ্ট শিশুখাদ্যও, এর চাহিদা বিশ্বে দিন দিন বাড়ছে। আমরা বিদেশ থেকে ছয় হাজার উন্নত কাজুবাদামের চারা এনেছি, সঙ্গে বীজও এসেছে। এগুলো চাষাবাদে সাতজন কৃষককে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, কাজুবাদাম চাষ করে বছরে ৪০০ কোটি ডলার আয় করছে ভিয়েতনাম। তাদের সাফল্যের বিষয়টি মাথায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামেও কফি-কাজুবাদাম চাষ করা হবে। কফি ও কাজুবাদামের চাষ এগিয়ে নিতে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে চারা। অপ্রচলিত ফসলের দিকে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী কাজুবাদামের ৯৯৪ কোটি ডলারের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই ৪০০ কোটি ডলার কাজুবাদাম রফতানি করে। বাকি কাজুবাদাম ভারত ও পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে রফতানি হয়। কাজুবাদামের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। কাজুবাদামের বৈশ্বিক বাজার ২০২৪ সাল নাগাদ ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পণ্যটির বাজার ৫ দশমিক ৫২০ কোটি ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাজার বড় হচ্ছে ইউরোপেও। চাইলে বাংলাদেশ খুব সহজেই পার্বত্য অঞ্চলের পতিত জমিতে বাগান করে এ বাজারের হিস্যা হতে পারে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশ থেকে বেশি কাজুবাদাম আমদানি করে। এটা বাংলাদেশের জন্য সামনে বড় একটি সুযোগ।
তবে দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ভালো মানের চারা সরবরাহ করতে হবে। এজন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। সম্ভাব্য এ প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে নীতিগতভাবে রাজি আছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, কাজুবাদামের যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, সেটির সফলতা পেতে মাঠ পর্যায়ে উৎপাদনে যেতে হবে। এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। এতে ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে নীতিগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প পাঠানো হলেও তা বিবেচনা করা হবে। আমার কাছে এ বিষয়ে প্রকল্প এলে অনুমোদনের ব্যবস্থা নেব, যাতে পাহাড়ে কাজুবাদামের চাষ সম্প্রসারণ করা যায়।
সূত্র: বনিক বার্তা
ফার্মসএন্ডফার্মার/০১জুলাই২০