মহামারি করোনাকালে লোকসান সামলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। সরকারের প্রণোদনায় আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ খাতটি। পোল্ট্রি সেক্টরের মুরগি ও ডিম রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, এমন প্রচারণায় গণমানুষের মধ্যে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এক বছর আগে করোনার শুরুতে এ খাতটি ভেঙে পড়লেও এখন পোল্ট্রি শিল্প বেশ মজবুত অবস্থানে ওঠে এসেছে। এ খাতে নতুন বিনিয়োগ বেড়েছে। বাজারে পোল্ট্রি মুরগি ও ডিমের দাম অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন পোল্ট্রি সেক্টরের ব্যবসা রমরমা হয়ে ওঠেছে।
পোল্ট্রি শিল্পে এখন আর বিনিয়োগের ঘাটতি নেই। প্রচুর বড় বড় কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেছে এবং তাঁরা ক্রমাগতভাবে দেশেই বিনিয়োগ করে চলেছেন। এখন কোয়ান্টিটি নয় বরং কোয়ালিটির দিকেই ঝুঁকেছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। অনেক বাধা পেরিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তারা রপ্তানি শুরু করেছেন। দেশের উদীয়মান খাত হিসেবে পোল্ট্রি শিল্পে দেশীয় বিনিয়োগ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিমান বাংলাদেশের যাত্রীদের উন্নতমানের খাবার সরবরাহের তাগাদা থেকেই বিদেশ থেকে উন্নতজাতের পোল্ট্রি মুরগি আমদানির প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ চাহিদা থেকেই স্থাপিত হয় ‘বিমান পোল্ট্রি কমপেস্নক্স’। ইউরোপ থেকে উন্নতজাতের মুরগির বাচ্চা দেশে এনে দেশেই শুরু হয় লালন-পালন। এসব মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা যদিও প্রাথমিকভাবে আমদানিকৃত ফিডের মাধ্যমেই পূরণ করা হতো; তবে বেসরকারি পর্যায়ে পোল্ট্রি পালন শুরু হওয়ায় দেশের ভেতরেই গড়ে উঠতে থাকে ফিড তৈরির কারখানা।
প্যারেন্টস্টক ফার্মের পর গড়ে উঠে গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) খামার। ফিড মিল থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক খামারেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। প্রযুক্তির আশির্বাদে আমূলে পাল্টে যেতে শুরু করে দেশীয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ। এ সময়ে দুয়েকটি ছোট আকারের পোল্ট্রি প্রসেসিং পস্ন্যান্টও গড়ে উঠে। বড় বড় কোম্পানি গড়ে উঠে; এদের মধ্যে কেউ কেউ ছোট খামারিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়িয়ে নিজস্ব কোম্পানিতে উৎপাদিত ফিড, বাচ্চা, ওষুধ ইত্যাদি সরবরাহের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং শুরু করে।
মানুষের ব্যস্ততা, চাহিদা ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বেই প্রসেসড ফুডের চাহিদা বাড়তে থাকে। শুরুতে বিদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত মুরগির মাংস থেকে প্রস্তুতকৃত খাদ্য বাংলাদেশে এলেও ধীরে ধীরে দেশীয় উদ্যোক্তারাও এ ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। একটি দু’টি করে বেশ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানির বিভিন্ন পদের পোল্ট্রিজাত খাদ্যের পসরা সাজাতে শুরু করে রাজধানী ঢাকার বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে। আকর্ষণীয় ও উন্নতমানের বাহারি মোড়ক ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। ফলে এ সময় পণ্যের ব্রান্ডিংও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেশের মানুষ সাধারণত জীবন্ত মুরগি কিনতেই অভ্যস্ত।
অবশ্য কোভিড-১৯ মহামারির সময় প্রসেসড মার্কেট নতুন করে আশা জাগিয়েছে। একদিকে বাড়ির বাইরে কিংবা কাঁচাবাজারে গেলে জীবাণু সংক্রমণের ভয়; অন্যদিকে রোগ প্রতিরোধে এন্টিবডি তৈরি বা ইমিউনিটি বৃদ্ধির অনুসঙ্গ হিসেবে প্রোটিন খাদ্য- ডিম ও মাংস গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রসেসড মুরগির চাহিদা বেড়েছে। বলা যায়, এ কারণে করোনা মহামারি চলাকালীন অন্যান্য শিল্পের চাকা বন্ধ হয়ে গেলেও ঘুরতে শুরু করে পোল্ট্রি প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির চাকা।
পোল্ট্রি শিল্পেও নতুন নতুন মডেল ও কনসেপ্ট এসেছে। আন্তর্জাতিকভাবে সেগুলোর অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। অনেক দেশেই পোল্ট্রি জোন হয়েছে; কম্পার্টমেন্টালাইজেশন করা হয়েছে- যা পোল্ট্রি রপ্তানিকে আগের তুলনায় বেশ খানিকটা সহজতর করেছে। বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক সংবাদ হচ্ছে- দেশীয় উদ্যোক্তাদের অদম্য প্রচেষ্টায় ২০১৯ সালে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের রপ্তানি শুরু হয়েছে এবং চলতি বছরে নেপালে রপ্তানি হতে যাচ্ছে একদিন বয়সি মুরগির বাচ্চা।
পোল্ট্রি খাতে পরিবর্তন আনতে হলে তৃণমূল খামারিদের সঙ্গে নিয়েই ইন্টিগ্রেশন শুরু করতে হবে। ক্ষুদ্র খামারিদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, পোল্ট্রি বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের আপডেট করতে হবে। দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে জুতসই দেশজ প্রযুক্তি ও কৌশলকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে পারফরম্যান্স বাড়ানো যায়, কীভাবে নিরাপদ ও অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত গ্রিন চিকেন মিট ও ডিম উৎপাদন করা যায় সে উপায় খুঁজে বের করতে হবে। পোল্ট্রিতেও কৃষির হারে বিদু্যৎ ও পানির বিল নির্ধারণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করতে হবে। সরকারিভাবে বিনামূল্যে জীবাণুনাশক ও পানি বিশুদ্ধকরণ ঔষধ, টিকা, ইত্যাদি প্রদান করতে হবে। ক্ষুদ্র খামারিদের ব্যাংক ঋণ সুবিধার আওতায় আনতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাম পর্যায়ের তৃণমূল খামারিদের ঋণ দিতে চায় না- যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে তাদের স্থানীয় মহাজন বা সুদের মহাজনের হাতে জিম্মি হতে হয়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৩ জানুয়ারি ২০২২