ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টা চাষে অনেক সুবিধা

1166

দেশে ভুট্টা দানাদার ফসল হিসেবে ধান ও গমের তুলনায় অনেকটা নতুন। এদেশে ভুট্টা ফসলের প্রবর্তন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৬০ সালের দিকে। মূলত সিমিট স্বল্প পরিসরে গবেষণার জন্য ভুট্টা আনে বাংলাদেশে। এদেশে ভুট্টা ফসলের চাষ শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। সিমিট কর্তৃক ভুট্টার মুক্ত পরাগী কিছু জাত যেমন- বর্ণালি, শুভ্রা, মোহর ইত্যাদি রিলিজ করার মাধ্যমে। পরবর্তিতে সিমিট ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) আরও কিছু মুক্ত পরাগী ও হাইব্রিড ভুট্টার জাত বের করে। বারি ও অনেকগুলো বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এর বদৌলতে ১৯৯০ সাল হতে এদেশে ভুট্টার বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয় এবং কৃষক পর্যায়ে এ ফসলটি ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ২০১৭ প্রযন্ত বারি কর্তৃক ১৫টি হাইব্রিড ও ৮টি মুক্ত পরাগী ভুট্টার জাত রিলিজ হয়েছে।

ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টা চাষে অনেক সুবিধা রয়েছে। এর বহুমুখী ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে ভুট্টার চাষ কৃষক পর্যায়ে দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চাষের আওতাধীন মোট জমির ৭৫ ভাগই ধানের আওতায় রয়েছে। এর পরেই ভুট্টার (৩%) অবস্থান যদিও কয়েক বছর আগেও এ দ্বিতীয় অবস্থানটি ছিল গমের। ১৯৯০ সালে বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টার চাষ শুরু হওয়ার পর প্রতি বছর প্রায় ১৫-২০% হারে এদেশে ভুট্টা চাষের প্রসার লাভ করে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এদেশে এর আগের বছরের ২০১৩-১৪ তুলনার ৭% বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ প্রসার লাভ করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫-১৬ বছরে এদেশে ভুট্টার উৎপাদন ছিল ২.৭৫ মিলিয়ন টন যা গমের বার্ষিক ফলনের ১.৩৫ মিলিয়ন টন এর দ্বিগুণ। দানার রং ও তার ব্যবহারের দিক থেকে নানা প্রকার ভুট্টা দেখা যায়।

যেমন-হলুদ ভুট্টা, সাদা ভুট্টা, খই ভুট্টা, বেবী কর্ণ প্রভৃতি। বাংলাদেশে গো-খাদ্য, মুরগী ও মাছের খাদ্য হিসেবে হলুদ ভুট্টা বেশ পরিচিত। শহর অঞ্চলে বেবি কর্ণ ও খই ভুট্টা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সাদা ভুট্টা সম্পর্কে তেমন কিছু আমরা জানি না। সাদা ভুট্টা এদেশে ১৯৮৬ সালে প্রবর্তন হলেও যথাযথ সম্প্রসারণ ও গবেষণার অভাবে এদেশে প্রসার লাভ করতে পারেনি। যদিও আফ্রিকা, দ. আমেরিকার অনেক দেশে সাদা ভুট্টা প্রধান দানাদার ফসল হিসেবে অতি সমাদৃত। বাংলাদেশেও এর প্রচুর সম্ভবনা রয়েছে।

এসব ভুট্টা ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপানসহ অন্যন্যে দেশে পারপাল বা বেগুনী ভুট্টা নামে আরও একটি ভুট্টা বেশ পরিচিত ও চাষ হয়। পার্পল বা বেগুনি ভুট্টা অনেক দেশে নীল বা লাল ভুট্টা নামেও পরিচিত। এ ভুট্টার দানা বা কার্নেল গাঢ় বেগুনি রঙের হওয়ায় একে পার্পল ভুট্টা বলে। পেরু, বলিভিয়া, ইকোয়েডর, চিলি প্রভৃতি দেশে পার্পল ভুট্টা হতে বেগুনি রঙের এক ধরনের জনপ্রিয় ও স্বাস্থ্যকর পানীয় তৈরি হয় যার নাম ছিছিয়া মোরাডা। তাছাড়া পার্পল ভুট্টার আটা হতে তৈরি মাঝামোরা পুডিং দক্ষিণ আমেরিকায় একটি জনপ্রিয় স্বাস্থ্যকর খাবার। বেগুনি ভুট্টার রঙের জন্য দায়ী এক শ্রেণির পানিতে দ্রবীভূত পলিফেলোলিক জাতীয় ফ্লাভিনায়েড শ্রেণীর এন্থোসায়নিন যৌগ যা এ জাতীয় ভুট্টাকে অন্য ভুট্টা হতে স্বতন্ত্র, দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয় ও স্বাস্থ্যকর করেছে। সায়ানিডিন-৩-গস্নুকোসাইড নামক এক প্রকার রাসয়নিক রঞ্জক বেগুনি ভুট্টার প্রধান উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ গ্রাম বেগুনি ভুট্টার আটায় প্রায় ৬২.৭ মি.গ্রা. এন্থোসায়ানিন পাওয়া যায়।

যেসব ভুট্টার বীজের আবরণ ও এলিয়োরণ বেগুনি রঙের হয় সে সব ভুট্টাতে অধিক পরিমাণে ১৪১.৭ মি. গ্রামেরও বেশি এন্থোসায়ানিন থাকে। দক্ষিণ আমেরিকা মোরাডা নামক বেগুনি ভুট্টার স্থানীয় জাতে প্রতি ১০০ গ্রাম আটাতে ১৬০০ মি. গ্রাম পর্যন্ত এন্থোসায়ানিন পাওয়া গেছে। উদ্ভিদজাত খাবারের পুষ্টি উপাদানের মধ্যে এন্থোসায়নিন একটি অন্যতম আকর্ষণীয় পুষ্টি উপাদান যার রয়েছে এন্টি-অক্সিডেন্টসহ অনেক স্বাস্থ্যকর গুণাগুণ। যার কারণে যুগযুগ ধরে রাজা-বাদশাসহ পুষ্টি সচেতন মানুষরা বেগুনি, নীল, কমলা, লালসহ নানা রঙের এন্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ খাবার খুঁজে বেড়ায়। এন্টি-অক্সিডেন্ট ছাড়াও এন্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ খাবারে রয়েছে এন্টি-ইনফ্লামেটোরি, এন্টি-ক্যান্সার, এন্টি-মাইক্রোবিয়াল, ও এন্টি-এজিং গুণাবলি। এন্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ খাবার শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল কমায়, স্থুলতা কমায়, ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণ রাখে, দৃষ্টি শক্তি বাড়ায়, স্নায়ু-ক্ষয়জনিত রোগকে দমন রাখে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও তারুণ্য ধরে রাখে।

শরীরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন বিক্রিয়ক অক্সিজেন বা মুক্ত মূলকের ক্ষতিকর প্রভাব হতে এন্থোসায়ানিন জাতীয় খাবার দেহকে রক্ষা করে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও দেহকে দীর্ঘ মেয়াদি রোগ হতে রক্ষা করে। বেগুনি ভুট্টায় বেগুনি রঙের জন্য দায়ী এন্থোসায়ানিনের সংশ্লেষন মূলত জীন বা এলেল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কৌলিতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে অনেক জীনের মধ্যে দুই শ্রেণির জীন প্রধানত এই এন্থোসায়ানিনের সংশ্লেষণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ জীনগুলোর প্রকট ও প্রচ্ছন্নতার ওপর এন্থোসোয়নিনের সংশ্লেষণের মাত্রা নির্ধারণ হয়। যেমন-গাঢ় বেগুনি বর্ণের ভুট্টায় দুইটি প্রকট জীনের সহ-অবস্থানে ও তাদের প্রকাশের জন্য বেশি পরিমাণে এন্থোসায়ানিন সংশ্লেষণ হয় ফলে ভুট্টা গাছ ও ভুট্টার দানা গাঢ় বেগুনি বর্ণের হয়। আবার এই জীনগুলো কি ধরনের কলাতে (টিস্যু) এবং জীবন চক্রের কোন সময়ে প্রকাশ ঘটে তার ওপর নির্ভর করে এন্থোসায়ানিনের সংশ্লেষণের অনেক বৈচিত্র্যতা। এই বেচিত্র্যতার জন্যই ভুট্টার এন্থোসায়ানিন রঙের সংশ্লেষন মাত্রার ভিন্নতা হয় এবং বিভিন্ন রঙের ভুট্টা (যেমন-কাল, বেগুনি, হালকা বেগুনি, লাল বা লালচে প্রভৃতি) দেখা যায়। বেগুনি ভুট্টায় প্রচুর পরিমাণে এন্থোসায়ানিন থাকায় পৃথিবীর অনেক দেশে এর চাহিদা ব্যাপক। পেরু, বলিভিয়াতে ইকেডোর ইত্যাদি দেশের মানুষরা বেগুনি ভুট্টা হতে স্বাস্থ্যকর ‘চিচিয়া মোরাডা’ পানীয় ও বেগুনি ভুট্টার আটা হতে বেগুনি রঙের রুটি, কেক, পুডিং ইত্যাদি তৈরি করে। তাছাড়া অপরিপক্ব বেগুনি ভুট্টা চিবিয়ে বা সালাদের সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন অনেক দেশেই রয়েছে। বেগুনি ভুট্টা হতে সংগৃহীত এন্থোসায়ানিন বিভিন্ন খাবারে রং করার জন্যও ব্যবহৃত হয়। জাপানে বেগুনি ভুট্টার এন্থোসায়ানিনের রং ফুড এডিটিভের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

এই রং বিভিন্ন খাবার যেমন- পানীয়, জ্যাম, জেলি, ক্যানডি, চকলেট ইত্যাদি খাবার রং করায় ব্যবহৃত হয়। আমেরিকার ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেগুনি ভুট্টার এন্থোসায়ানিন অন্যান্য ফসল যেমন- আঙ্গুর, বেগুনী গাজর, চকবেরী হতে সংগৃহীত এন্থোসায়ানিনের চেয়ে ৫০% ভাগ বেশি ক্যান্সার বৃদ্ধি রোধ করতে পারে। উক্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে বেগুনি ভুট্টার এন্থোসায়ানিন ২০% ক্যান্সারের সেলকে অবস্থায় মেরে ফেলতে পারে। গবেষণায় তাছাড়া আরও দেখা গেছে বেগুনি ভুট্টার এন্থোসায়ানিন স্থুলতা ও ফুলে যাওয়া (এন্টি-ইনফ্লামেটোরি) প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ ২০১৫ সাল হতে বেগুনি ভুট্টার জাত উদ্ভাবনে গবেষণা করে আসছে। দীর্ঘ গবেষণার ফলস্বরূপ বর্তমানে বেগুনি ভুট্টার কিছু ফলনশীল অগ্রসর লাইন উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ সমস্ত বেগুনি ভুট্টার দানা গাঢ় বেগুনি রঙের এবং এমনকি সম্পূর্ণ ভুট্টা গাছের রঙ গাঢ় বেগুনি বর্ণের হয়।

এমনকি ভুট্টার পুরুষ ফুল (টাসেল) এবং স্ত্রী ফুলও (কবস) সম্পূর্ণ বেগুনি বর্ণের হয়। এ বেগুনি ভুট্টার ফলন ৫-৬ টন/হে : এবং রবিতে ১১০-১১৫ দিনে ও খরিপে ৯০-৯৫ দিনে ভুট্টা সংগ্রহ করা যায়। এ বেগুনি ভুট্টার চাষ প্রণালি অন্য ভুট্টার মতোই একই রকম। ড. জামিলুর রহমান আশা করছেন ২০১৯ সালের মধ্যে আগ্রহী কৃষকের মধ্যে এ বেগুনি ভুট্টার বীজ সরবরাহ করতে পারবেন। ভুট্টা একটি বহুমুখী শস্যে এবং পুষ্টিমানে ভুট্টা অনেক শস্যের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর। বেগুনি ভুট্টার খাবার মান বিশেষ করে আমিষ ও এন্থোসায়ানিনের পরিমাণ বেশি থাকায় জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করা যায়। তাই বেগুনি ভুট্টার উপযুক্ত জাত উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে এর সম্প্রসারণ একান্ত প্রয়োজন।

লেখক. ড. জামিলুর রহমান, অধ্যাপক, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮এপ্রিল২০