ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করার আধুনিক কলাকৌশল

623

ধান ক্ষেতে মাছ চাষঃ ধান ক্ষেতে নির্দিষ্ট সময় ধরে বর্ষার পানি জমে থাকে যা নিঃসন্দেহে মাছ চাষেরজন্য একটি আদর্শপরিবেশ। ধান ক্ষেতে ব্যবহৃত সার, গোবর ইতাদি, পানি ও মাটির সাথে মিশে প্রাকৃতিকভাবে খাবার তৈরি করে যা মাছ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধানক্ষেতে মাছ চাষের প্রযুক্তি ব্যবহারকরে একজন চাষী ধান উৎপাদনের সাথে সাথে বাড়তি আয়ওপেতে পারে । আমন ও বোরো দুই মৌসুমেই ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা সম্ভব। তবে আমনমৌসুমে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ বেশী লাভজনক। সেচ সুবিধার আওতাধীন যে সমস্ত ধান জমি রয়েছে সেসকল জমিতে স্বল্প ব্যয়ে এবং স্বল্প পরিশ্রমে ধানের পাশাপাশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শুধু অর্থই যোগান দেয় না সেই সাথেতাদের পুষ্টিও নিশ্চিত করে।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা:
􀂾 একই জমি থেকে ধানের সাথে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মাছ পাওয়া যায় সুতরাং জমিরসর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব।
􀂾 ধান ক্ষেতে আগাছা কম জন্মেএবং অনিষ্টকারী পোনা-মাকড় মাছ খায়ে ফেলে। ফলে ধানক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
􀂾 মাছের চলাফেরার মাধ্যমে ক্ষেতের কাদামাটি উলটপালট হয় ফলে জমি হতে ধানের পক্ষেঅধিকতর পুষ্টিগ্রহণযোগ্য হয়।
􀂾 মাছের বিষ্টা সার হিসাবে ধান ক্ষেতের উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে।

ধান ক্ষেতে চাষ পদ্ধতি:

সাধারণত: দুই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা যায়ঃ

১.ধানের সাথে মাছের চাষ
􀂾 একই জমিতে ধান ও মাছ একত্রে চাষ করা হয়।
􀂾 আমন মৌসুমে মাঝারি উঁচু জমিতে যেখানে ৪-৬ মাস বৃষ্টি পানি জমে থাকে সেখানে ধানেরসাথে মাছ চাষ করা যায়।
􀂾 বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধার আওতাধীন জমিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় ।

২. ধানের পরে মাছের চাষ:
􀂾 বাংলাদেশের যে সমস্ত জমি বর্ষাকালে প্লাবিত হয় এবং রোপা আমন চাষ করা হয় না সেখানে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়।
মাছ চাষের জন্য জমি নির্বাচন:
সব ধান ক্ষেত মাছ চাষের জন্য উপযোগী নয় । ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে জমিনির্বাচনের ওপর । জমি নির্বাচনের সময় নিš§লিখিত বিষয়সমূহের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জমিনির্বাচনের সময় বিবেচনাধীন বিষয়সমুহঃ

􀂾 সাধারণত: দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং এটেল মাটির পানি ধারণ ক্ষমতাএবং উর্বরা শক্তিবেশি বিধায় এসব মাটির জমি ধানক্ষেতে মাছ চাষের জন্যউপযোগী।
􀂾 অতি উঁচু অর্থাৎ পানি ধরে রাখাতেপারে না এবং অধিক নীচু জমি অর্থাৎসহজেই প্লাবিতহয়সেসবজমিমাছচাষের অনুপযোগী।
􀂾 বন্যার পানি প্রবেশ করে না এরূপ উঁচুজমিই মাছ চাষের উপযোগী।
􀂾 বোরো মৌসুমে চাষের ক্ষেত্রে সেচেরসুবন্দোবস্ত থাকতে হবে।

ধান ক্ষেত প্রস্তুতকরণ:
􀂾 যথাযথভাবে চাষ ও মই দিয়ে ধান চাষের প্রচলিত নিয়মে জমি প্রস্তুত করতে হবে। এতেএকদিকে যেমন ক্ষেত আগাছামুক্ত হবে তেমনি জমি কাদা হয়ে ধান রোপণের উপযুক্ত হবে।
􀂾 ক্ষেতের চারপাশের আইল কমপক্ষে ০.৩ মিটার বা ১ ফুট উঁচু ও ১ ফুট চওড়া করে তৈরীকরতে হবে। তবে আইলের উচ্চতা নির্ভর করবে জমির অবস্থানের ওপর।

􀂾 জমির যে অংশ অপেক্ষাকৃত ঢালু সে অংশে জমির শতকরা ২-৩ ভাগ এলাকা জুড়ে কমপক্ষে২-৩ ফুট গভীর একটি ডোবা খনন করতে হবে, যা ক্ষেতের কোণায়, পাশে বা মধ্যে হতেপারে।

􀂾 শুঙ্ক বা খরা মৌসুমে অথবা অন্য কোন কারণে জমির পানি শুকিয়ে গেলে উক্ত গর্ত মাছের জন্যসাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
􀂾 জমি তৈরির জন্য প্রচলিত নিয়মেই জমিতে সার, গোবর ইত্যাদি প্রয়োগ করে ধান রোপণকরতে হবে ।

ধানের জাত নির্বাচন:
ধানের জাত নির্বাচনে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবেঃ
􀂾 সমন্বিত ধান-মাছ চাষের ক্ষেত্রে যে জাতের ধান বেশী পানি সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবংফলনও বেশী সেই জাত নির্বাচন করতে হবে ।
􀂾 আমন মৌসুমের জন্য বি আর-৩ (বিপব), বি আর-১১ (মুক্তা), বি আর-১৪ (গাজী) এবংবোরো মৌসুমের জন্য বি আর-১৪ ও বি আর-১৬ ইত্যাদি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানউপযোগী।

􀂾 ধানের সাথে মাছের চাষের জন্য ধানের চারা অবশ্যই সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে।সেক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫-২০সেমি. রাখাতে হবে।

মাছের প্রজাতি নির্বাচন:
মাছের প্রজাতি নির্বাচন লক্ষ্যনীয় বিষয়সমূহঃ
􀂾 অগভীর পানিতে চাষ করা যায় এমন প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে।
􀂾 কম অক্সিজেনে বাঁচতে পারে এমন প্রজাতির মাছ।
􀂾 দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে। যেমন- রাজপুঁটি, মিরর কার্প, মনোসেক্সগিফট তেলাপিয়া ইত্যাদি ।

মাছের পোনা মজুদ
􀂾 ধান ক্ষেতে ধান রোপণের পরপরই পোনা মজুদ করতে হয় না, রোপনের পর ধানের চারামাটিতে শিকড় মেলে শক্ত হতে ও ধানের কুশী গজাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে । এ জন্য১৫-২০ দিন পর ধান ক্ষেতে মাছের পোনা মজুদ করতে হয়।
􀂾 জমিতে কমপক্ষে ১০-১৫ সেমি. পানি থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১৫-২০টি ৫-৭ সেমি.আকারের রাজপুঁটি/মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়া/ মিরর কার্পের পোনা ছাড়তে হবে।

􀂾 উভয় জাতের মাছ একত্রে চাষ করার ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৮টি রাজপুঁটি ও ৭টি মিরর কার্পেরপোনা ছাড়া যেতে পারে।
􀂾 সকালে অথবা বিকালে অর্থাৎ যখন পানি ঠান্ডা থাকে তখন ক্ষেতে পোনা মজুদ করা উচিত। এনিয়মে পোনা মজুদ করলে ধান চাষকালীন সময়ের অর্থাৎ ১০০-১২০ দিনের মধ্যেই মাছখাওয়ার ও বিক্রয়ের উপযোগী হয়ে থাকে।
􀂾 মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়ার মিশ্রচাষ না করে একক চাষ করতে হবে।

ধান ক্ষেতে পানি ব্যবস্থাপনা:
􀂾 মাছ ধান ক্ষেতে থাকা অবস্থায় সবসময় পানি থাকতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষেতে পানিরগভীরতা ১০-১৫ সেমি. থাকতে পারে, তবে মাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির গভীরতা বাড়াতেহবে।

􀂾 যদি কোন সময় বাইরে থেকে পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়, তখন পুকুর বা ভূগর্ভস্থ পানিসরবরাহ করতে হবে।
􀂾 ইঁদুর, কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণী যাতে আইলে গর্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
􀂾 অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি জমে ক্ষেত প্লাবিতহওয়ারআশংকাথাকলেঅপেক্ষকৃতঢালুঅংশেআইলের কিছু জায়গা ভেঙ্গে বাঁশের বানা বা ছাঁকনিযুক্ত পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করেদিতে হবে।

􀂾 ধান ক্ষেতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাবারই মাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। তবে প্রাকৃতিকখাবারের অপর্যাপ্ততা পরিলক্ষিত হলে প্রয়োজনবোধে মাছের খাবার হিসেবে ক্ষুদিপানা বাচালের কুঁড়া সরবরাহ করা যেতে পারে।
􀂾 প্রচলিত নিয়মে জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

􀂾 সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতিতে পোকা-মাকড় দমন করা যেতে পারে।
􀂾 ধান ক্ষেতের মাছকে ডোবা বা নালায় স্থনান্তরের পর প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগকরতে হবে।
􀂾 কীটনাশক ব্যবহারের পর বৃষ্টি হলে ৫-৭ দিন পর মাছগুলোকে ক্ষেতে যাওয়ার সুযোগ করেদিতে হবে। আর যদি বৃষ্টি না হয় সে ক্ষেত্রে ৫-৭ দিন পর সেচের মাধ্যমে পুনরায় মাছকেসমস্ত জমিতে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে।
􀂾 কীটনাশক ব্যবহারের উপযুক্ত সময় হলো বিকেল বেলা কারণ এ সময় ধানের পাতা শুঙ্কথাকে।
􀂾 পাশের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানো হলে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কীটনাশক মিশ্রিত পানিকোনক্রমেই মাছের ক্ষেতে প্রবেশ না করে।
􀂾 ধান রক্ষার জন্য জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে মাছকে আইলের সাহায্যে গর্তেআটকে রাখতে হবে।
􀂾 অতিরিক্ত গরমবা খরার সময় ক্ষেতে গর্তের পানি ঠান্ডা রাখার জন্য গর্তের কিছু অংশেকচুরিপানা রাখতে হবে ।
􀂾 ক্ষেতের পানির প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেলে দ্রুত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

ধান ক্ষেতে মাছ আহরণ:
􀂾 ধান পাকার পর ক্ষেতের পানি কমিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা নিতে হবে, এসময় মাছ আস্তে আস্তেডোবায় চলে যাবে এবং মাছ ধরতে হবে।
􀂾 ধান ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে ৩-৪ মাসে হেক প্রতি ৩২৫-৩৫০ কেজি মাছএবং ২.০-২.৫ টন মাছের ফলন পাওয়া যায়।
􀂾 অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ধানের সাথে মাছ চাষ করলে ধানের ফলন গড়ে প্রায় শতকরা১৫ ভাগ বেশি হয়। এতে চাষীরা অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকে।

পরামর্শ:
􀂾 ধান ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারে সর্তকথাকতে হবে।
􀂾 অতি বৃষ্টিতে যেন ধান ক্ষেত প্লাবিতনাহয় অথবা খরায় ধান ক্ষেত পুকিয়ে নাযায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
􀂾 চাষীকে দৈনিক সকাল ও বিকালে ধানক্ষেত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

লেখকঃ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৫ আগস্ট ২০২১