নরসিংদীতে এবার ১৫ হাজার মেট্রিক টন লটকন উৎপাদন

357

লটকন
আমজাদ হোসেন বেলাব, নরসিংদী থেকে: নরসিংদীতে লটকন চাষ করে ব্যাপক সাফল্য পাচ্ছেন চাষিরা। আর্থিক লাভের কারণে চাষিদের মধ্যে লটকন চাষে উৎসাহের পাশাপাশি প্রতি বছরই এখানে বাড়ছে বাগানের সংখ্যা। বর্তমানে নরসিংদীর উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের সমতল পাহাড়ি লালমাটি এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত মণ লটকন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে যাচ্ছে।

নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ জানান, এ বছর নরসিংদী জেলায় প্রায় এক হাজার ৩৬৯ হেক্টর জমিতে লনকট চাষ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেলাবতে -১২৩ হেক্টর, শিবপুরে-১২০০ হেক্টর, মনোহরদীতে-১০ হেক্টর, রায়পুরায়-৩১ হেক্টর ও পলাশে-৫ হেক্টর। মওসুমে এখানে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন লটকন উৎপাদন হয়, যার আনুমানিক দাম ৪০-৪৫ কোটি টাকা।

চাষিরা জানান, লটকন উচ্চ সমতল সব ধরনের জমিতেই জন্মে। এক সময়ের পরিত্যক্ত ভূমি এখন লটকন চাষ করে তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে। আগে গ্রামে-গ্রামান্তরের কোনো কোনো বাড়িতে কদাচিৎ লটকন গাছ দেখা যেত। চাহিদা তেমন ছিল না বলে কেউ এটিকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের কথা চিন্তা করত না। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর ক্যালোরি, খাদ্য ও পুষ্টিগুণ সমৃব্ধ এ ফলের চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে ফলের মূল্যও। মাটি ও জাতগুণে লটকনের মধ্যে টক ও মিষ্টি দুই প্রকারেই পাওয়া যায়। তবে অধিক মিষ্টি ও সামান্য টক স্বাদের লটকনের চাহিদা বেশি।

নরসিংদীর উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সুউচ্চ গৈরিক বা লাল রঙের মাটিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ উপাদান বিদ্যমান থাকায় এ মাটিতে লটকনের উৎপাদন ভালো হচ্ছে। স্বাদে-গন্ধে হচ্ছে মিষ্টি এবং আকৃতিতেও হচ্ছে বড় বড়। নরসিংদীর রায়পুরা, শিবপুর, বেলাব, মনোহরদী ও পলাশ উপজেলার শত শত চাষি বর্তমানে লটকন বিক্রি করে অর্থনৈতিক সাফল্য ফিরিয়ে আনছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, শিবপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লটকনের বাগান রয়েছে। ২০ বছর আগেও লটকনের স্বতন্ত্র বাগান ছিল না। তখন অন্যান্য ফলগাছের সাথেই দু-একটি গাছ লাগানো হতো। লটকন চাষিরা জানান, পূর্বসময়ে লটকনের তেমন চাহিদা ছিল না, দামও ছিল কম, সে কারণে কেউ লটকনের স্বতন্ত্র বাগান করার চিন্তা করত না। বর্তমানে চাহিদা ও মূল্য দু’টিই বেড়েছে।

অন্যান্য ফলের চেয়ে লটকনের ফলন অনেক বেশি হয় বলে কৃষকেরাও অধিক লাভবান হচ্ছেন। লটকন গাছের কাণ্ডে এবং ডালপালায় ফলে। গাছের পুষ্টির সুষমতা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গাছের গোড়া থেকে প্রধান কাণ্ডগুলোতে থোকায় থোকায় এত বেশি ফল আসে যে, তখন গাছের কাণ্ড বা ডাল দেখা যায় না। বেলাব উপজেলার লাকপুর গ্রামের লটকন চাষি নুরুর হাছান জানান, এ বছর তিনি লটকন বিক্রি করে ১৬ লাখ টাকা পেয়েছেন। লটকন বিক্রির ভাবনা এখন তাদেরকে ভাবতে হচ্ছে না। স্থানীয় পাইকারেরা বাগান থেকে প্রতি মণ লটকন দু-হাজার থেকে আড়াই হাজার দরে কিনে নিচ্ছে। তা ছাড়া শিবপুর ও মরজাল বাজার থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারি ক্রেতারা এসে লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখানকার উৎপাদিত শত শত মণ লটকন চাহিদা মেটাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মিস্টার মিয়া জানান, প্রতি কেজি লটকন তারা ঢাকায় নিয়ে ৯০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকেন। স্থানীয় লাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও লটকন চাষি জাহাঙ্গীর আলম জানান, লটকন গাছে নারী-পুরুষ রয়েছে। ফল আসার আগ পর্যন্ত নারী-পুরুষ চিহ্নিত করা দুষ্কর। চারা লাগানোর কমপক্ষে পাঁচ বছর পর ফল আসে।

প্রথম দিকে চাষিরা চারার জন্য নার্সারিগুলোর ওপর নির্ভর করলেও এখন তা করছেন না। এখন নিজেরাই চারা তৈরি করছেন। বহু অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে এবং এক বিচি বিশিষ্ট লটকটন থেকে অধিক নারী গাছের জন্ম নেয়। তা ছাড়া চারা অবস্থায় গাছের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে অভিজ্ঞরা নারী চারা শনাক্ত করতে পারেন। বাছাইয়ের এ পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত না হলেও চাষিরা বেশ সাফল্য পাচ্ছেন।

দেখা গেছে, বাগানগুলোতে নির্দিষ্ট দূরত্বে তিনটি করে চারা রোপণ করা হচ্ছে। পাঁচ বছর পর প্রথম ফল এলে নারী গাছ রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। অন্য কোনো ফলে সাধারণত এত টাকা আয় হয় না। লটকন চাষে রোগ বালাই তেমন একটা নেই। চাহিদাও প্রচুর, এসব কারণেই দিন দিন নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় লটকন চাষের প্রসার ঘটছে। এ ছাড়া দেশের পাশাপশি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে এখানকার লটকনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।সূত্র: এনডি

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন