গরমে যখন মানুষ অতিষ্ট, সেই সময় একটু বাঙ্গি প্রাণে এনে দেয় প্রশান্তি। দূর করে শরীরের সব ক্লান্তি। গ্রীষ্মকাল আসার আগেই নরসিংদীর চরাঞ্চলের মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে বাঙ্গি। বাঙ্গি চাষে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চল।
এ অঞ্চলের বাঙ্গি আকারে বড়, দেখতে সুন্দর ও সুস্বাদু হওয়ায় রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। অল্প শ্রম ও অল্প খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় প্রতি বছরই চরাঞ্চলে বাড়ছে বাঙ্গির চাষ। ফলে এ অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে মৌসুমী কর্মসংস্থানের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চারটি ইউনিয়নে বাঙ্গি চাষাবাদ হয়। ইউনিয়নগুলো হলো, বাঁশগাড়ি, শ্রীনগর, চরমধূয়া ও মির্জাচর। তবে এর মধ্যে বাঁশগাড়ি ইউনিয়নেই সবচেয়ে বেশি বাঙ্গির আবাদ হয়। এছাড়া নরসিংদী সদর, রায়পুরা, বেলাবো, মনোহরদী, পলাশ ও শিবপুরে কম বেশি বাঙ্গি চাষ হয়। তবে এর মধ্যে রায়পুরা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি বাঙ্গি চাষ হয়।
গত মৌসুমে জেলা জুড়ে ৬৫ হেক্টর জমিতে বাঙ্গি চাষ হয়। তার মধ্যে শুধুমাত্র রায়পুরাতেই ৪০ হেক্টর জমিতে বাঙ্গি চাষ করা হয়। তবে এ মৌসুমে জেলায় বাঙ্গি চাষের ফলন বেড়ে দাঁড়িয়েছ ৭৩ হেক্টরে। যার মধ্যে রায়পুরাতেই ৪৫ হেক্টর জমিতে এবার বাঙ্গির চাষ হয়। গত মৌসুমের তুলনায় জেলায় এবার ৮ হেক্টর জমিতে বেশি বাঙ্গি চাষ হয়।
রায়পুরার চরাঞ্চলের বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের মধ্যনগর ও চান্দেরকান্দি গ্রামের কৃষকরা তাদের জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বাঙ্গি চাষ করে। শুধু মধ্যনগর বা চান্দেরকান্দি নয় বর্তমানে আশপাশের বেশ কয়েকটি চরে বাঙ্গির আবাদ হচ্ছে। এই সব চরের উৎপাদিত বাঙ্গির আকার বড় ও রং উজ্জ্বল হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে বাঁশগাড়ি ও শ্রীনগর ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল চর। বিস্তৃর্ণ চরের ধান ও মসলা জাতীয় ফসলের পাশাপাশি বাঙ্গি চাষ করা হয়েছে। মাটির ওপর ছড়িয়ে রয়েছে বাঙ্গিগাছের সবুজ লতা। লতার ফাঁকে ফাঁকে কাঁচা-পাকা বাঙ্গি শোভা পাচ্ছে।
বাঙ্গি চাষি আরমান বলেন, ‘বাঙ্গি চাষে খরচ কম। রসুনের সঙ্গে সাথী ফসল হিসাবে বাঙ্গি চাষ করা হয়। রসুনের জন্য সার দেওয়ায় বাঙ্গির জন্য আলাদা করে সার লাগে না। বীজ ও ওষুধেই যা খরচ। গত বছর প্রতি কানি জমিতে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তবে এ বছর প্রতি কানি জমিতে খরচের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০-৮০ হাজারে। এ বছর গত বছরের তুলনায় ফলন বেশি হওয়ার আশা করছি।
বাঙ্গি চাষ শুধু কৃষকদের সমৃদ্ধি আনেনি সৃষ্টি হয়েছে মৌসুমী কর্মসংস্থানের। মৌসুমী শ্রমিকরা জমি থেকে বাঙ্গি ঝুঁড়িতে তুলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নৌকা কিংবা ভ্যানে ভর্তি করে নিয়ে চলছে বিভিন্ন বাজারে। এতে পুরো চরে চোখে পড়ে কৃষক ও শ্রমিকের ব্যাপক কর্মচঞ্চলতা।
চান্দেরকান্দি গ্রামের দিন মুজুর আবু সিদ্দিক বলেন, ‘বাঙ্গির পুরা মৌসুমে এই গ্রামের কেউ বইস্যা থাহে না। সবাই কিছু না কিছু করে। জমি থাইক্যা টানে নিলে আসলে বাঙ্গিপ্রতি ৫ টাকা পাই। একে পাথিতে ১০ থেকে ১৫টা বাঙ্গি ধরে। এতে প্রতিদিন আমরা ৮শ থেকে এক হাজার টাকা মজুরি পাই।
চরে পাইকারী বাঙ্গি বিক্রি হয় শতক হিসেবে। আকারভেদে প্রতি’শ বাঙ্গি গত বছর বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকায়, তবে এবছর চাহিদা বেশি থাকায় প্রতি’শ বাঙ্গি ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায় পাইকারী বিক্রি হচ্ছে।
জমি থেকে বাঙ্গি কিনছিলেন নরসিংদী থেকে আসা পাইকারী ফল ব্যবসায়ী মারুফ বলেন, এ বছর বাঙ্গির দাম অনেক বেশি। অন্যান্য বছর প্রতি’শ বাঙ্গি ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় কিনতাম। যেখানে প্রতি বাঙ্গির দাম পরতো ৩০-৪০ টাকা এখন প্রতি’শ বাঙ্গি কিনতে হয়েছে ৯ হাজার টাকায়। বাঙ্গি প্রতি খেত থেকে কেনা পরছে ৯০ টাকা। এছাড়া লেভার খরচ, গাড়ি ভাড়া মিলিয়ে প্রতিটি বাঙ্গি ১০০ টাকার ওপর দাম হয়।
বাঙ্গি ক্রয় করতে আশা নরসিংদী সদরের হানিফ মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের হোসেন আলী ও রায়পুরার তুহিন মিয়া বলেন, মধ্য নগরের বাঙ্গি আকারে বড়, দেখতে সুন্দর ও খেতে সুস্বাদু। এজন্য তারা প্রায় প্রতিবছরই এখানে পাইকারি দরে বাঙ্গি কিনতে আসেন।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আজিজুর রহমান জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর বাঙ্গির ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর জেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে বাঙ্গির ফলন হয় তবে এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হেক্টরে। এর মধ্যে রায়পুরায় সবচেয়ে বেশি ৪৫ হেক্টর জমিতে বাঙ্গির চাষ হয়েছে। এছাড়া সদরে ৮ হেক্টর, পলাশে ৩ হেক্টর, শিবপুরে ২ হেক্টর, মনোহরদীতে ৫ হেক্টর, বেলাবো ১০ হেক্টর জমিতে এ বছর বাঙ্গির চাষ হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছর কৃষকেরা ভালোই হবেন।