নাটোর থেকে: চলতি শীত মৌসুমে জেলায় অন্তত ৫৩ কোটি টাকার প্রায় ৯ হাজার টন খেজুর গুড় উৎপাদিত হবে। এ লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ প্রায় সাড়ে চার লাখ খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
শীত মৌসুমে গ্রামীণ জনপদে খেজুর গাছকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আরো গতিশীল হচ্ছে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলার ৭টি উপজেলায় মোট খেজুর গাছের সংখ্যা পাঁচ লাখ ২৯ হাজার ৭৩২টি। কিছু গাছ অপরিপক্ক এবং কিছু গাছ না কাটায় রস সংগ্রহের উপযোগী চার লাখ ৪৩ হাজার ৭৭০টি গাছ থেকে গাছ প্রতি গড়ে ১৮৬ লিটার করে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ২০ কেজি করে আট হাজার ৮৭৫ টন গুড় উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ন্যুনতম ৬০ টাকা কেজি হিসেবে উৎপাদিত গুড়ের বাজার মূল্য ৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, রস সংগ্রহের উপযোগী মোট চার লাখ ৪৩ হাজার ৭৭০টি গাছের মধ্যে অর্ধেকেরও অধিক- দুই লাখ ৯০ হাজার ৫০০টি গাছের অবস্থান লালপুর উপজেলায়। শুধু গাছের সংখ্যাই নয়, রস ও গুড় সংগ্রহের পরিমানেও এ উপজেলা অনেকটাই অগ্রগামী।
সিংড়া উপজেলায় গাছ প্রতি সর্বনিম্ন ১৪০ লিটার রস থেকে ২০ কেজি গুড় এবং গুরুদাসপুর উপজেলায় গাছ প্রতি ১৮০ লিটার রস থেকে সর্বনিম্ন ১৮ কেজি করে গুড় পাওয়া গেলেও লালপুরে গাছ প্রতি সর্বোচ্চ ২৫০ লিটার রস থেকে সর্বোচ্চ ২৫ কেজি করে গুড় পাওয়া যায়।
গ্রামীণ জনপদের নবান্ন উৎসবের অপরিহার্য উপাদান খেজুরের রস আর গুড়। শীত মৌসুমকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করে গুড় তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে, চলবে মধ্য মার্চ পর্যন্ত।
গুড় তৈরিতে খেজুর রস জ্বাল দেয়ার সময় মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামীণ জনপদের বাতাসে। শীতের সকালে সোনা ঝরা রোদে খেজুরের রস আর মুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা। শহর থেকে অনেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসতে শুরু করেছেন- খেজুরের রস আর টাটকা খেজুর গুড়ে তৈরি রকমারী পিঠাকে উপলক্ষ করে।
সড়ক পথ, রেল লাইনের দুই ধার, জমির আইল, বাড়ির আঙিনাসহ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা খেজুর গাছ থেকে রস আহরণে বর্তমানে ব্যস্ত সময় অতিক্রম করছেন গাছিরা। একজন গাছি প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করতে পারেন এবং শীত মৌসুমের ১২০ দিনে একটি গাছ থেকে প্রায় অন্তত: ২৫ কেজি গুড় পাওয়া যায় বলে জানান লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া এলাকার গাছি রমজান আলী।
গাছিরা তিন ধরনের চুক্তিতে কাজ করেন। প্রথমত গাছ ইজারা নিয়ে গাছের মালিক ও তার মধ্যে আধা-আধি রসের বাটোয়ারা। দ্বিতীয়ত পুরো মৌসুমে গাছের মালিককে গড়ে পাঁচ কেজি করে গুড় দিয়ে অবশিষ্ট নিজে নেয়া। তৃতীয়ত পুরো মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের বিনিময়ে নির্ধারিত পারিশ্রমিক নেয়া।
লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া এলাকার নান্দ গ্রামের গৃহস্থ কৃষক আব্দুল কুদ্দুস জানান, ৩০০ খেজুর গাছ থেকে পর্যায়ক্রমে রস সংগ্রহের জন্যে দুইজন গাছির প্রত্যেকে প্রতিদিনের খোড়াকি ছাড়াও মাসে নয় হাজার করে টাকা নেবেন।
খেজুর গাছ ফসলের কোন ক্ষতি করেনা বরং মাটির ক্ষয় রোধ করে। এ গাছের জন্য বাড়তি কোন খরচ করতে হয়না। ঝোপ-জংগলে কোন প্রকার যত্ন ছাড়াই অনাদর অবহেলায় বড় হয়ে উঠে খেজুর গাছ। শুধুমাত্র শীত মৌসুমেই নিয়মিত পরিষ্কার করে রস সংগ্রহ করা হয়। রস এবং গুড় ছাড়াও খেজুর গাছের পাতা দিয়ে মাদুর তৈরি ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়। টিনের চালা ঘরের তীর তৈরিতে খেজুর গাছ অনন্য।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কৃষকদের খেজুর গাছ লাগানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি- যা রস ও গুড়ের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি কৃষক পরিবারে সচ্ছলতা বয়ে আনে। শীত মৌসুমে খেজুর গুড় তৈরির কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতিতে গতিশীলতা তৈরি হয়।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন