নারীর হাত ধরেই কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়েছে

1087

KRISHE-5
নারীর হাত ধরেই কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়েছে। আধুনিক যুগেও কৃষিতে তাদের অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এক দশকে যেখানে কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। মাঠভিত্তিক কৃষিকাজ ও গৃহভিত্তিক কৃষিকাজ এ দুটি পর্যায়েই নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমজরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত দুই কোটি ৫৬ লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ ছিলেন নারী। তার এক দশক আগে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৮ লাখ। এক দশকের ব্যবধানে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ নারী। জরিপ অনুযাযী ১০ বছরের ব্যবধানে কৃষিতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ, পক্ষান্তরে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে সাড়ে তিন শতাংশ।

বিবিএসের রিপোর্ট অনুযায়ী, কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন ৬৮ দশমিক এক শতাংশ নারী। তারা কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার তিনটি পর্যায় যথা- প্রাক বপন প্রক্রিয়া, বীজ বপন ও ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং ফসল-উত্তর প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকেন। তাছাড়া ফসল উত্তরণ প্রক্রিয়ায় মাড়াই, বাছাই শুকানো ও আহারযোগ্য করে তোলার কাজের বেশিরভাগ দায়িত্বই পালন করেন নারী। এছাড়াও কৃষির অবিচ্ছেদ্য অংশ গবাদি পশু পালন ও কৃষি সরঞ্জামাদি তৈরিকরণে যেমন-ডালি, ঝাড়, কুলা, চালুনি ইত্যাদি তৈরিতে নারী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার হিসেবে ছাইয়ের ব্যবহার, লম্বা বাঁটযুক্ত কোদাল, বেলচা, সাধারণ লাঙল, শস্যচক্র এ সবই নারীর উদ্ভাবন।

কৃষিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে দরিদ্র ভূমিহীন এবং উপজাতি নারীদের বেশি সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়। উপজাতি নারীরা ফসল লাগানো, পরিচর্যা এবং ফসল কাটার মৌসুমে দল বেঁধে মাঠে কাজ করেন। অর্থাৎ কৃষিতে শ্রমশক্তি সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা তৈরিতে নারীদের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কৃষিকাজে সম্পৃক্ত নারী একই সঙ্গে ঘরের কাজ ও কৃষিকাজ সম্পাদন করেন।

তারপরও এ দেশে কৃষিক্ষেত্রে নারীর অবদান অদৃশ্য ও অস্বীকৃত রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে কৃষি খাতে অংশগ্রহণকারী নারী শ্রমিকের কোনো সংখ্যা তথ্য নেই। কৃষিকাজে সম্পৃক্ত নারী কৃষক মজুরি প্রাপ্তিতে বৈষম্যেরও শিকার হন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়। ফলে কৃষিকাজে পুরুষের সমান অংশগ্রহণ করেও নারীর পরিচয় থাকছে কেবল গৃহিণী হিসেবে। কৃষিতে নারী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মজীবী নারী সংগঠনের নেতারা দীর্ঘাদিন ধরে কৃষি শ্রম আইন ও একটি কৃষি কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছেন।

তাদের মতে, কৃষি খাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টিতে, অথচ কৃষিকাজে নারীর স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। তারা নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান করা, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সরকারি কৃষি কর্মকপ্রন্ড নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিগত এক দশকে এক কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ২০ লাখ শ্রমিক।

কৃষিতে নতুন কর্মসংস্থানের ইঙ্গিত দিলেও দেশের কৃষি খাতের গতিশীলতা, কৃষিতে ন্যায্য মজুরি অথবা কৃষি শ্রমিকের বাজারে প্রবেশাধিকার কিছুই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। শ্রমশক্তির সংখ্যা অনুযায়ী ২৯ শতাংশ নারী অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকার পরও শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে অদৃশ্যই থেকে যাচ্ছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ নারী গৃহসহ কৃষিকর্মে সরাসরি অবদান রাখছেন। কিন্তু তাদের শ্রমকে শ্রমশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় না। কারণ তাদের এ কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। এদিকে অতীতে বাজেটেও নারীকে কৃষির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে এবং কৃষি খাতের অন্যতম উৎপাদক হিসেবে গণ্য করতে কৃষি খাতে সর্বমোট বরাদ্দের ২৬.৫৩ শতাংশ নারীদের কল্যাণে ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে।

তাছাড়া আগে থেকেই জাতীয় কৃষি নীতিতে নারীর জন্য প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়নে সহায়তা করার কথা বলা হয়ে আসছে। মাঠে ফসল উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণ এবং সেজন্য আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ ও কৃষিতে নারীর অবদান রাখার ক্ষেত্রে প্রতবন্ধকতা চিহ্নিত করে বিভিন্ন গবেষণা করার কথাও বলা হয়েছে। চিহ্নিত অসুবিধা দূর করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ওপরও জোর দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। এতসব কর্মসূচি ও কার্যকর পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাস্তবে কৃষিতে নারীর অবদান এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি গৃহপালিত পশুপালন থেকে শুরু করে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের আয়ের টাকার ভাগও নারীকে দেয়া হয় না। কিন্তু কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের ফলে একদিকে যেমন দেশের খাদ্যনিরাপত্তা বাড়ছে অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কৃষিখাতকে গতিশীল করতে হলে সঠিক বিবেচনার ভিত্তিতে কৃষাণি নারীদেরও ‘কৃষক কার্ড’ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দিতে হবে তাদেরও সরকারি কৃষি প্রণোদনা। তা হলেই সামনের দিনে নারীরা কৃষিতে নতুন বিপ্লব ঘটাতে আগ্রহী হয়ে ওঠবেন।

ফার্মসএন্ডফার্মার/৭ফেব্রু২০২০