নিবিড় পদ্ধতিতে শিং চাষ

869

পুকুরে শিং মাছ চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা। ভালো করে চাষ করতে পারলে কার্পজাতীয় মাছের তুলনায় শিং মাছ চাষে লাভ বেশি। তাছাড়া কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমেও পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশি শিং মাছের পোনা উৎপাদন এবং চাষ করা সম্ভব। কেননা শিং মাছ বাজারের একটি দামি মাছ। কথায় আছে, শিং মাছ খেলে দ্রুত রক্ত বৃদ্ধি হয়। তাহলে জেনে নিন কীভাবে চাষ করবেন।

পোনা মজুদ

এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশি শিং মাছের পোনা পাওয়া যায়। দেশি শিং মাছ একক চাষের জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ পোনা মজুদ করা যাবে। শিং মাছ চাষে পুকুরে ৪-৫ ইঞ্চি সাইজের প্রতি শতাংশে ৮-১০ পিচ রুই, কাতল, গ্রাসকার্প, মৃগেল মাছের পোনা ছাড়তে হবে। কিছু কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়লে পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে।

পুকুর নির্বাচন

পুকুর নির্বাচনের সময় কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে-

১. পুকুর অবশ্যই বন্যামুক্ত হতে হবে।
২. পুকুরের পাড় মজবুত হতে হবে। কোন প্রকার ছিদ্র থাকলে সমস্ত শিং মাছ চলে যাবে।

৩. বৃষ্টির সময় পানির উচ্চতা ৪ ফুটের বেশি হবে না- এমন পুকুর নির্বাচন করতে হবে।
৪. পুকুর আয়তাকার হলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

৫. পুকুরের আয়তন ৪০-৫০ শতাংশের মধ্যে হতে হবে।
৬. এক প্রান্ত অন্য প্রান্তের চেয়ে ১ ফুট ঢালু রাখতে হবে।

পুকুর প্রস্তুত

নতুন পুকুরের চেয়ে পুরাতন পুকুরে শিং মাছ চাষ ভালো হয়। নতুন পুকুর হলে ভালোভাবে চাষ দিয়ে প্রতি শতাংশে কমপক্ষে ২০ কেজি গোবর ও ভালোভাবে মই দিয়ে তারপর চুন দিতে হবে। পুরনো পুকুর হলে প্রথমেই সেচ দিয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে। এরপর চুন দিতে হবে শতাংশ প্রতি ১ কেজি। চারদিকে জাল দিয়ে ভালোভাবে ঘের দিতে হবে। চারপাশে জাল দেওয়ার পর পুকুরে শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে ২-৩ ফুট পরিষ্কার পানি দিতে হবে। পানি দেওয়ার ২-৩ দিনের মধ্যে পোনা ছাড়তে হবে। পোনা ছাড়ার পর এক ইঞ্চি ফাঁসের একটি জাল পেতে রাখতে হবে।

মজুদ ঘনত্ব

শিং মাছ এককভাবে বা মিশ্রভাবে চাষ করা যায়। মিশ্রভাবে চাষ করতে হলে কার্প জাতীয় মাছের সাথে প্রতি শতাংশে ৩০টি পর্যন্ত আঙুল সাইজের শিং মাছের পোনা ছাড়তে হবে। পোনা মজুদের সময় পোনাকে এন্টিফাঙ্গাস মেডিসিনে গোসল দিয়ে তারপর ছাড়তে হবে। কার্প জাতীয় মাছ ছাড়া তেলাপিয়া এবং পাঙ্গাসের সাথেও শিং মাছের মিশ্রচাষ করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৫০টি পর্যন্ত শিং মাছের পোনা মিশ্রভাবে ছাড়া যায়। কার্পজাতীয়, তেলাপিয়া বা পাঙ্গাসের সাথে শিং মাছ চাষ করলে বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় না।

খাবার প্রয়োগ

পোনা মজুদের পর প্রথম ১০ দিন দৈনিক মাছের ওজনের ২০% খাবার প্রয়োগ করতে হয়। ছোট থাকা শিং মাছ সাধারণত রাতের বেলায় খেতে পছন্দ করে; তাই ২০% খাবারকে দু’বেলায় সমান ভাগ করে ভোরের দিকে একটু অন্ধকার থাকতে প্রয়োগ করতে হয়। মাছ মজুদের পরের ১০ দিন ১৫% হারে এবং এর পরের ১০ দিন মাছের ওজনের ১০% হারে পুকুরে খাবার প্রয়োগ করতে হয়। এভাবে এক মাস খাবার প্রয়োগের পর ৫% হারে পুকুরে খাবার দিতে হবে। শিং মাছ ৩ ইঞ্চি হওয়ার সাথে সাথে দিনের বেলাতে খাবার দিতে হবে। সন্ধ্যার পর যে খাবার দেওয়া হত সেটি সন্ধ্যার একটু আগে এগিয়ে এনে আস্তে আস্তে বিকেলে দিতে হবে। অন্যদিকে ভোরবেলার খাবারও এমনি করে সকাল ৯-১০ টার দিকে পিছিয়ে নিতে হবে। শিং মাছের ওজন ১৫ গ্রাম হলে ৩% এর অধিক খাবার দেওয়া মোটেই ঠিক নয় এবং বিক্রির আগ পর্যন্ত এই নিয়মই বজায় রাখতে হবে।

নিবিড় পদ্ধতিতে শিং চাষে ৫ মাসে লাভ ১১ লাখ টাকা

নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষে আগ্রহ বেড়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মাছ চাষিদের। কম জমিতে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে চাষির সংখ্যা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে পুকুরে শিং মাছের নিবিড় চাষে এক নবদিগন্ত সৃষ্টি হয়েছে। ময়মনসিংহ সদরের মাঝিহাটি গ্রামের আবু রায়হান নামে এক খামারি বিএফআরআইয়ের এ নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে ৫ মাসে ৩২ শতাংশের পুকুর থেকে খরচ বাদে আয় করেছেন ১১ লাখ টাকা।

শিং চাষি আবু রায়হান জানান, তিনি শুরু থেকেই বিএফআরআই ইনস্টিটিউটের নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছের চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। পুকুরের ও মাছের নিয়মিত পরিচর্যা ও যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি মাছের জন্য নিয়মিত সুষম খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা জানান। এছাড়াও যে বিষয়গুলো তিনি খেয়াল রেখেছেন তা হলো পুকুরে একই আকারের শিং মাছের পোনা মজুদ করা, বিশেষ করে স্ত্রী পোনা মজুদ করা, অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করা, নিয়মিত চুন ও লবণ প্রয়োগ করা। তা ছাড়া, নিয়মিত পানি পরিবর্তন করা হয়েছে ও পুকুরের গভীরতা তুলনামূলক বেশি রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, তিনি ২০১৯ সালের জুন মাসে তার ৩২ শতাংশের পুকুরে শতাংশ প্রতি ৪ গ্রাম ওজনের শিং মাছের ৫ হাজার পোনা মজুদ করেন। ৫ মাস পর আহরণকৃত ওইসব মাছের গড় ওজন হয় ৫২ গ্রাম। শতাংশপ্রতি ২৮০ কেজি করে মোট উৎপাদন হয় প্রায় ৯ হাজার কেজি। প্রতিকেজি মাছ ২৮০ টাকা করে বিক্রি করে মোট আয় করেন প্রায় ২৫ লাখ টাকার। এতে ৫ মাসে ৩২ শতাংশের পুকুর থেকে খরচ বাদে মোট আয় করেন ১১ লাখ টাকা।

বর্তমানে বিএফআরআইয়ের কারিগরি সহযোগিতায় শিং মাছের নিবিড় চাষে অনেকে ক্রমেই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। মাঝিহাটিপাড়া গ্রাম ছাড়াও ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা, নান্দাইল, হালুয়াঘাট, ভালুকা, শেরপুরের নকলা এবং নোয়াখালীর চাটখিলের মৎস্য চাষিরা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিং মাছের নিবিড় চাষাবাদ শুরু করেছেন।

বিএফআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএইচএম কোহিনূর জানান, সাধারণত মৎস্য চাষিরা আধানিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ করে থাকেন। বিএফআরআইয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, পুকুরে সহজেই শিং মাছের নিবিড় চাষ করা সম্ভব। বর্তমানে চাষকৃত অন্যান্য মাছের তুলনায় উচ্চ মূল্যের শিং মাছের নিবিড় চাষ অধিক লাভজনক।

এ ধরনের চাষবাদের ক্ষেত্রে পুকুরকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, যাতে পুকুরের পানি কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। এ ক্ষেত্রে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হয়। ক্ষতিকর জলজপ্রাণীর প্রবেশ রোধে পুকুরের চারপাশে ফিল্টার জাল দিয়ে বেষ্টনী দেওয়া যেতে পারে। খামারে চাষকালে মাছ রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে পুকুরের জৈব নিরাপত্তা ও রোগ প্রতিরোধী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

সাধারণত পোনা মজুদের ৬-৭ মাস পর মাছ আহরণ করতে হয়। এ সময়ে মাছ গড়ে ৫৫-৬৫ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। পুকুর পুরোপুরি শুকিয়ে শিং মাছ আহরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ পদ্ধতি অনুসরণে ৫০ শতাংশের পুকুর থেকে ৭ মাসে ৮-৯ টন শিং মাছ উৎপাদন করা যায়।

বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, বাংলাদেশে শিং অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাছ। রুইজাতীয় মাছের চেয়ে এদের বাজারমূল্য অনেক বেশি। বিএফআরআইয়ের গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ করা হলে মৎস্য খাতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন হবে। এ প্রযুক্তি এখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। ফলে দেশের মানুষের কাছে শিং মাছ আয়ের একটি সহজলভ্য পদ্ধতি হবে। পাশাপাশি চাষিরাও সঠিকভাবে আর্থিক লাভবান হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৯জুন ২০২১