সামনে বর্ষা মৌসুম। এ সময় দেশের নিম্নভূমিগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। এসব অঞ্চলের গরু-মহিষের জন্য ঘাস তো দূরের কথা, কয়েক মুঠো খড় জোটানোও কঠিন। এ সময় অভাবের তাড়নায় অনেকে গরু-মহিষ কম দামে বিক্রি করে দেন। অনেকের গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া খাদ্যাভাবে দুর্বল হয়ে যায় ।
বর্ষা মৌসুমে বাড়ির পাশের জমিতে ধান উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পতিত জমিতে পানি ও আগাছা বেশি হয়ে থাকে। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই এরকম লাখ লাখ একর পতিত জমি সারা বছরই খালি পড়ে থাকে। একটু সচেতন হলেই আমরা এ জমিগুলো কাজে লাগিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করতে পারি । বর্ষা মৌসুমসহ সারা বছরই এ জমিগুলোতে নেপিয়ার জাতীয় ঘাস চাষ করে গো-সম্পদের প্রসার ঘটানো যায় । নেপিয়ার ঘাস পরিত্যক্ত জায়গায় ভালো জন্মে। লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। দুই সপ্তাহ অন্তর ঘাস কাটা যায়। নেপিয়ার ঘাস চাষ খুব সহজ এবং ব্যয়ও কম। গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এ ঘাস খুব পছন্দ করে। তাই এরা সহজেই বেড়ে ওঠে।
নেপিয়ার ঘাস এর উপযোগী জলবায়ু ও ভূমি :
এ ঘাস সব ধরনের মাটিতেই জন্মে। তবে বেলে দো-আশ মাটিতে এর ফলন সবচেয়ে বেশি। এ ঘাসের জন্য উঁচু জমি ভালো। বন্যা প্রস্তাবিত জমি এ ঘাস চাষের জন্য অনুপযুক্ত। বাংলাদেশের আবহাওয়া নেপিয়ার ঘাস চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত।
জমি নির্বাচন:
পানি নিষ্কাশনের জন্য ভাল ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ যেখানে বৃষ্টি বা বর্ষার পানি জমে থাকে না এরূপ জমি নেপিয়ার চাষের জন্য উত্তম। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই এ ঘাস রোপন করা যায়, তবে বেলে-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী।
চাষের সময়ঃ
নেপিয়ার ঘাসের বীজ সারা বৎসরই রোপন করা যায়। প্রচন্ড শীত এবং বর্ষার পানির সময় বাদে সব সময় বীজ বপন করা যায় তবে কাটিং এর ক্ষেত্রে সাধারণতঃ বর্ষার প্রারম্ভে এই ঘাসের কাটিং বা চারা রোপন করা হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ্য মাসে প্রথম বৃষ্টির পর জমিতে চারা বা কাটিং লাগালে প্রথম বছরেই ৩/৪ বার পর্যন্ত ঘাস কাটা যেতে পারে। চারা বা কাটিং লাগানোর পর যদি রৌদ্র হয় বা মাটিতে রস কম থাকে তাহলে চারার গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে।
আরোও পড়ুন উন্নত গুনাগুনসম্পন্ন ছাগল নির্বাচন কৌশল
চাষ পদ্ধতি :
এ ঘাস চাষের জন্য জমিতে চার থেকে পাঁচটি চাষ দিয়ে এবং মই দিয়ে আগাছামুক্ত করার পর রোপণ করতে পারলে উত্তম।
জমি প্রস্তুতের সময় :
১.৫০ থেকে ২.০০ টন জৈবসার- প্রতি একরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ ইত্যাদি সার ব্যবহার করতে পারেন।
বীজ বপনঃ প্রথমে বীজ ১-২ ঘন্টা মিষ্টি রোদে শুঁকিয়ে তারপরে নরমাল করে ২৪-৪৮ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন তারপরে জমিতে ছিটিয়ে দিন। পরবর্তী ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে বীজ জার্মিনেশন হয়ে যায়। চারা ৩-৪ ইঞ্চি হবার পরে একটি সেচ দিতে পারলে ভালো।
সার প্রয়োগ ও পানি সেচ :
ভালো ফলন ও গাছের বৃদ্ধির জন্য সার এবং পানির প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে পানি সেচের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্য সময়ে সাধারণত পানি সেচের প্রয়োজন হয় এবং ইউরিয়া ১৫০ কেজি, টিএসপি ৮০ কেজি, ও এমওপি ৭০ কেজি সার প্রয়োগ করতে হবে।
ঘাস কাটার পদ্ধতি:
বীজ থেকে চারা হবার পর থেকে ৩৫-৪০ দিন পর প্রথমবার ঘাস সংগ্রহ করা যায়, মাটির ৫-৬ ইঞ্চি উপর থেকে ঘাস কাটতে হয়।তিন সপ্তাহ পরপর পুনরায় ঘাস কাটা যায়। প্রথম কাটিং-এ ফলন একটু কম হলেও দ্বিতীয় কাটিং থেকে পরবর্তী ২/৩ বছর পর্যন্ত ফলন বাড়তে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে কমতে থাকে। পরে পুনরায় বীজ অথবা কাটিং বা মোথা লাগাতে হবে। প্রত্যেকবার ঘাস কাঁটার পর একর প্রতি ৬০-৭০ কেজি ইউরিয়া, ৪০-৫০ কেজি টিএসপি, ৪০-৫০ কেজি এমওপি এবং ২-৩ টন গোবর/ কম্পোস্ট সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
খাওয়ারনোর নিয়মঃ
জমি থেকে ঘাস কাটার পর ঘাস যাতে শুকিয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। আস্ত ঘাস গবাদিকে খেতে দিলে অপচয় বেশি হয়। তাই মেশিন, দা অথবা কাঁচি দ্বারা ২-৩ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে খাওয়ানো ভাল। এই কাটা ঘাস খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। এ ছাড়া দুই থেকে তিন ইঞ্চি করে কেটে খড়ের সঙ্গে মিশিয়েও খাওয়ানো যায়। নেপিয়ার ঘাসে শতকরা ৭-১২ ভাগ প্রোটিন আছে।
নেপিয়ার ঘাস শুকিয়ে সংরক্ষণ করা সুবিধাজনক নয়। তবে কাঁচা ঘাস সাইলেজ করে শুষ্ক মৌসুমে সংরক্ষণ করা যায়।
সতর্কতা:
নেপিয়ারের জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগের পর অনেক দিন খরা হলে ইউরিয়া হতে নাইট্রেট বা নাইট্রাইট ঘাসের মধ্যে উৎপন্ন হতে পারে এবং পরবর্তীতে অধিক বৃষ্টিপাত হওয়ার পর দ্রুত বেড়ে ওঠা এই ঘাস কেটে খাওয়ানো ঝুকিপূর্ণ। এতে বিষক্রিয়া হতে পারে।
ঘাস কাটার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করলে বিষক্রিয়ার প্রভাব থেকে গবাদিপশুকে মুক্ত রাখা যায়।
(১) জমিতে সার ছিটাবার ২ সপ্তাহের মধ্যে ঘাস কাটা উচিত নয়।
(২) সার ছিটাবার পরে দীর্ঘ দিন খরা থাকার পর হঠাৎ অধিক বৃষ্টিপাতের পর দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ঘাস কেটে খাওয়ানো উচিত নয়।
(৩) ঘাস কাটার একমাস পূর্বে সার ছিটানো উচিত।
নেপিয়ার উচ্চ ফলনশীল ঘাস। এই ঘাস চাষের মাধ্যেমে গবাদিপশুর কাঁচা ঘাসের চাহিদা মিটানো সম্ভবপর। কাঁচা ঘাস/সাইলেজের ব্যবহার যথাযথভাবে করতে পারলে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে যা দ্বারা ক্রমান্বয়ে দেশের দুধের চাহিদা মিটানো সম্ভব। সম্প্রতি আমাদের দেশে দুধের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে দুধ উৎপাদন বাড়লে কৃষকের যেমন আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে তেমনি দেশের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি ঘটবে।
চাষিরা যাতে ঘাসের কাটিং বা চারা সংগ্রহ করতে পারে সেজন্য প্রতিটি উপজেলায় ঘাসের চারা বিতরণের ব্যবস্থা রয়েছে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৯এপ্রিল২০