শরিফুল ইসলাম, নড়াইল থেকে: নড়াইলে কাঁঠালের ভালো ফলনে কৃষকরা খুশি হলেও দামে হতাশ তারা। বাগান থেকে ব্যবসায়ীরা কাঁঠাল কিনে বাজারে নিয়ে তিনগুনেরও বেশি দামে বিক্রয় করলেও চাষিদের কোনো লাভ হচ্ছে না। কাঁঠালের লাভের টাকা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।
যে দামে বাগান থেকে কাঁঠাল বিক্রি করছেন চাষিরা এতে তাদের খরচও উঠবে না বলে চাষিদের অভিযোগ। ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন কাঁঠালের বাজার জমে উঠেছে। নড়াইলের কাঁঠাল যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
এ বছর জেলায় মোট কাঁঠালের আবাদ হয়েছে ৭৫০ হেক্টর জমিতে। তবে বাণিজ্যিকভাবে আবাদ হয়েছে ৩৫৫ হেক্টর জমিতে। হিসাব অনুযায়ী, আবাদকৃত জমিতে মোট ৭ হাজার ৫শ মে. টন কাঁঠাল উৎপাদন হবে।
জেলার তিনটি উপজেলায় ১২টি হাটে পাইকারি দামে কাঁঠাল বিক্রি হয়। এর মধ্যে নড়াইল শহরের রুপগঞ্জ হাট সবচেয়ে বড়। এখানে সপ্তাহে দুইদিন (রোববার ও বৃহস্পতিবার) কাঁঠালের হাট বসে।
নড়াইল জেলার তিনটি উপজেলা ছাড়াও মাগুরা, ঝিনাইদহ, খুলনা, বাগেরহাট ও যশোরসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা এখানে কাঁঠাল কেনাবেচা করতে আসেন। রুপগঞ্জ হাটসহ জেলার বিভিন্ন হাটে আকারভেদে প্রতি ১শ পিস কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫শ টাকা পর্যন্ত। অথচ চাষিদের বাগান থেকে প্রতি ১শ পিস কাঁঠাল স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কিনছেন ৭শ থেকে ১২শ টাকায়।
সদরের চাঁনপুর গ্রামের কাঁঠালচাষি মুক্তার শেখ জানান, এক হেক্টর জমিতে কাঁঠাল চাষ করতে বছরে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। এবছর কাঁঠালের দাম অনেক কম। যে দামে বিক্রি করছেন এতে তার খরচও উঠবে না। তার অভিযোগ, এতে প্রকৃত চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর লাভবান হচ্ছে এলাকার কিছু ব্যবসায়ীরা।
লোহাগড়া উপজেলার বাড়িভাঙ্গা গ্রামের কাঁঠালচাষি আবদুস সাত্তার জানান, তার বাগানে এ বছর কাঁঠালের ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু দাম গতবার থেকে অনেক কম। প্রতি ১শ পিস কাঁঠাল তিনি গড়ে ৭শ থেকে ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি করছেন। এতে তার অনেক লোকসান হয়েছে।
মাগুরা জেলার গঙ্গারামপুর থেকে রুপগঞ্জ বাজারে কাঠাল বিক্রি করতে আসা ব্যবসায়ী উৎপাল বিশ্বাস জানান, তিনি আট বছর ধরে এই বাজারে এসে কাঁঠালের ব্যবসা করেন। মাগুরা ও নড়াইলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে চাষিদের কাছ থেকে তিনি কাঁঠাল কিনে বাজারে বিক্রি করেন। পাইকারি বাজারে প্রতি ১শ পিস কাঁঠাল এ বছর ৩ হাজার ৫শ টাকা থেকে ৪ হাজার ৭শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। এতে তার ব্যবসা অনেক ভালো হচ্ছে।
জেলার কালিয়া উপজেলার পেড়োলি গ্রাম থেকে রুপগঞ্জ বাজারে কাঁঠাল কিনতে আসা ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ জানান, তিনি ২৮ বছর ধরে এই ব্যবসা করেন। প্রতি বছরই তিনি এই বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে খুলনা ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। নদীপথে পরিবহন খরচ কম হওয়ায় চিত্রা নদী পথেই ট্রলারে করে তিনি খুলনা ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান। প্রতিপিস কাঁঠাল পরিবহন করতে খরচ হয় ৬ টাকা করে। একটি ট্রলারে ৫ থেকে ৬ হাজার পিস কাঁঠাল বহন করা যায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, এই বাজারে কাঁঠাল ক্রয়-বিক্রয়কারী উভয়কেই খাজনা হিসাবে প্রতিপিস কাঁঠালের জন্য ২ টাকা করে দিতে হয়। প্রতি এক পিস কাঁঠালের জন্য খাজনা হিসাবে ইজারাদার পান ৪ টাকা। ব্যবসায়ীদের দাবি, ক্রয় অথবা বিক্রয়ের ওপর একবার খাজনা নেয়া হোক।
রুপগঞ্জ বাজারের দিনমজুর ইয়াছিন মৃধা জানান, প্রতি হাটের দিন তিনি বাজার থেকে নদীতে ট্রলারে কাঁঠাল তোলার কাজ করেন। এক পিস কাঁঠাল ট্রলারে তুললে তিনি মজুরি হিসাবে পান ৩ টাকা করে। প্রতিদিন তিনি এই কাজ করে ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা ইনকাম করেন।
তিনি আরও জানান, যখন কাজের চাপ থাকে রাতেও এই কাজ করতে হয় তাকে। রাতে কাজ করলে আরও বেশি মজুরি পান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নড়াইলের উপ-পরিচালক শেখ আমিনুল হক বলেন, “অনেক আগে থেকে জেলায় কাঁঠালের আবাদ হলেও বাণিজ্যিকভাবে এখানে এই চাষ হত না। গত কয়েক বছর ধরে নড়াইল জেলার চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ করছেন। এখানকার মাটি কাঁঠাল চাষের জন্য উপযোগী। এখানে কাঁঠালের আবাদ ভালো হয়। গত কয়েক বছর ধরে চাষিরা বেশ ভালো লাভ করেছে। দিন দিন এর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবছর আমের ফলন ভালো হওয়ায় কাঁঠালের চাহিদা একটু কম থাকায় বাজারে কাঁঠালের দাম কিছুটা কম।”
তিনি আরও জানান, চাষিরা যাতে ঠিকমতো এই চাষ করতে পারে এবং লাভবান হতে পারে সেই ব্যাপারে সব সময় খোঁজ-খবর রাখা হয়। চাষিদের সঠিক পরামর্শ দেয়া হয় কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে, যাতে তারা ঠিকমতো কাঁঠালের আবাদ করতে পারে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম