পদ্মার চরে কৃষি বিপ্লবে সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছে চাষীরা

41

 

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এক সমৃদ্ধ ভূমি, যার জীবনধারা ও অর্থনীতি প্রকৃতির নানা মোড় নিয়েছে। এর মাঝে রয়েছে পদ্মা নদী, যা এক সময় প্রমত্তা হয়ে তার বুক চিরে বহু গ্রাম ও ফসলের মাঠ গ্রাস করে নিয়েছে, আজ তার বুকে জেগে ওঠা চরে নতুন জীবন ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন বুনে চলেছে।

এক সময়ের ধ্বংসলীলা ও বিপর্যয়ের কাহিনী আজ পরিণত হয়েছে উর্বর পদ্মাচরের কৃষিজমি হিসেবে। এই চরাঞ্চলগুলো, যেগুলো এক সময় পানির নিচে থাকত, এখন বছরের নির্দিষ্ট সময়ে শুকনো থাকে এবং কৃষকরা এখানে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে থাকেন।

পদ্মাচরে চাষ হচ্ছে পেঁয়াজ, রসুন, ধান, গম, ভুট্টা, মসুর, মটরশুঁটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টমেটো, শিম জাতীয় নানা শাকসবজি। এই চাষাবাদের মাধ্যমে না শুধু কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে, বরং অর্থনৈতিক উন্নতিও সাধন হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মা নদীর মধ্য ভাগে চর সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে নদীর জলপ্রবাহ বিভিন্ন দিকে বিভক্ত হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পানির স্রোত বহমান থাকলেও, অন্যান্য স্থানে বালুর চর প্রসারিত হয়ে আছে। এসব চরে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ এবং গবাদি পশুর পালন করা হচ্ছে। তবে নদীতে পানির অভাবের কারণে, চরের বাসিন্দারা যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন।

চর মাজার দিয়াড় এলাকার নৌকার মাঝি রুমন বলেন, নদীতে পানি কম। পানি কম থাকার কারণে অনেক দূর দিয়ে ঘুরে নৌকা নিয়ে যেতে হয়। এতে সময়ও বেশি লাগে। খরচও বেশি হয়। আগের মতো নৌকায় ইনকাম (উপার্জন) নেই। আগে দিনে চার থেকে পাঁচ বার যাওয়া আসা করতাম। এখন কমে গেছে। রোজা লাগার পরে মানুষ তেমন পারাপার হচ্ছে না। তবে ১৫ রোজা থেকে মানুষ পারাপার বাড়বে। কারণ মানুষ ঈদের বাজার করতে রাজশাহীতে আসবে।

বছরের আড়াই থেকে তিন মাস পদ্মায় ঠিকমতো পানি থাকে। বাকি সময় ধুধু বালুচর। এই বালুচরে প্রায় ১৩ ধরনের ফসল। মসুর, গম, সরিষা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ছাড়াও ভুট্টা বোরো ধান, পেঁয়াজের চাষাবাদ হয়। বিশাল এই চাষজজ্ঞের সঙ্গে চরের বিপুল পরিমাণ জড়িত। চরের এই মানুষ সাধারণত কৃষি পেশার ওপরে নির্ভরশীল। আর নদীতে পানি থাকলে মাছ ও নৌকা চালায় আয় হয় তাদের। অনেকেই আবার রাজশাহী শহরে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। তারা শহরে বিভিন্ন দোকানে সেল্সম্যানের কাজ করেন। কেউ কেউ ব্যাটারিচালিত রিকশা বা অটোরিকশা চালায়। এছাড়া অনেকেই আবার বিভিন্ন গবাদি পশু পালন করে থাকেন। সেই পশু বিক্রি করে তাদের জীবিকা পরিচালনা করে থাকেন।

অন্যদিকে, রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার জেলে রয়েছেন, যার মধ্যে পদ্মা নদীতে মাছ ধরা নিয়ে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১২ হাজার। নদীতে পানির অভাবে এসব জেলেকে জীবিকার অন্যান্য পথ খুঁজতে হচ্ছে। আলী হোসেন, রাজশাহী নগরীর মিজানের মোড়ের এক বাসিন্দা, যিনি পদ্মা নদীতে মাছ ধরে তার জীবিকা নির্বাহ করতেন, এখন পানির অভাবে মাছ ধরতে না পেরে অটোরিকশা চালানোর কাজ করছেন।

মো. সাগর, যিনি প্রায় ২০ বিঘা জমিতে মসুরের চাষ করেছেন, জানান যে তিনি প্রতি বছর মসুরের পাশাপাশি অন্যান্য ফসলও চাষ করে থাকেন। চরের ফসল চাষে খরচ কম বলে তিনি উল্লেখ করেন। চাষাবাদ প্রক্রিয়া সহজ এবং মাঝে মধ্যে ফসলের যত্ন নিতে হয়। গত বছরের তুলনায় এবার মসুরের ফলন বেশি হয়েছে।

ধানের চাষ করেন নাইমুল ইসলাম। তিনি জানান, তিনি প্রতি বছর ধান চাষ করে থাকেন এবং এ বছরও তা অব্যাহত রেখেছেন। তবে, বীজ এবং শ্রমিকের মজুরির দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেশি হচ্ছে। উন্নত ফলন পেলে তারা লাভের মুখ দেখতে পাবেন। পদ্মা নদীর পলি মাটিতে ধান চাষ করে তারা ভালো ফলন পেয়ে থাকেন। পদ্মার চরে প্রতি বিঘা ধান চাষে খরচ হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। ভালো ফলন পেলে বিক্রি করে খরচের টাকা উঠিয়ে সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ফেরানো সম্ভব।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, রাজশাহী জেলার আওতায় পদ্মার ১৪টি চর। এ চরের আয়তন ১৪ হাজার ৮৫৩ হেক্টর। যার মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ১০ হাজার ১৮৭ হেক্টর। পদ্মাচর এবং তার আশপাশের চরাঞ্চলগুলো রাজশাহী জেলার কৃষি অর্থনীতিতে অপরিহার্য একটি ভূমিকা রাখছে। এই চরাঞ্চলগুলোতে উর্বর জমি এবং আবাদ উপযোগী পরিবেশের সুবাদে বছরভর বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ হয়। ধান, গম, খেসারি, মরিচ, পেঁয়াজ, বাদাম, তিল, ভুট্টা ইত্যাদি ফসলের চাষ এই এলাকার কৃষকদের জীবিকা নির্বাহে সহায়ক হয়ে উঠেছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, এটি স্পষ্ট যে, চরাঞ্চলগুলোতে কৃষি কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন ফসলের চাষ বেড়েছে। এই এলাকার কৃষকরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখেও তাদের কৃষি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, যা স্থানীয় অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা উন্নতিতে অবদান রাখছে। পদ্মাচর এবং আশপাশের চরাঞ্চলগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, এখানকার জমি উর্বর এবং চাষাবাদে খরচ অপেক্ষাকৃত কম। তবে, যেসব চরে পানি সরবরাহের সুবিধা কম, সেখানে ফসল চাষে খরচ বেশি হয়। নদীভাঙন এবং নতুন চর সৃষ্টির ফলে জমি-জমা হারানো পরিবারগুলো নতুন চরে চাষাবাদের মাধ্যমে তাদের জীবিকা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।