ডেস্কের ওপর বইখাতার ঝুলি রেখে ছেলেমেয়েরা ক্লাস করছে। এক একটা ক্লাস ৫০ মিনিট দীর্ঘ। এরকম সাত সাতটা ক্লাস শেষ করতে হবে। তবে ক্লাস শেষ হলেই বাড়ির পথে হাঁটা যাবে না। কারণ স্কুলের ঘর, করিডোর এমনকি বাথরুম পরিষ্কার করার দায়িত্বও শিক্ষার্থীদের।
ক্লাস শেষ হলেই শিক্ষক নির্দেশনা দেবেন- প্রথম দুই সারি ক্লাসরুম পরিষ্কার করবে, তৃতীয় ও চতুর্থ সারি পরিষ্কার করবে করিডোর আর সিঁড়ি এবং পঞ্চম সারি বাথরুম পরিষ্কার করবে। ক্লাসরুমের পেছনেই রয়েছে একটি কাপবোর্ড। যেখানে সাজানো থাকে ঝাড়ু, মপ, কাপড়, বালতি ইত্যাদি সরঞ্জাম।
শিক্ষার্থীরা একে একে নিজেদের কাজ অনুযায়ী সরঞ্জাম নিয়ে লেগে পড়ে স্কুলের পরিচ্ছন্নতায়। জাপানের স্কুলগুলোয় এমন চিত্রই দেখা যায়।
যেকোনো পর্যটকই যখন প্রথম জাপানে পা রাখেন তখন বিস্মিত হন- একটা দেশ এত ঝকঝকে-তকতকে হয় কী করে!
কোথাও একবিন্দু ময়লা নেই। ফের অবাক হন যখন দেখেন রাস্তার পাশে কোনো ময়লা ফেলার ঝুড়ি নেই, নেই রাস্তা পরিষ্কার করার কোনো পরিচ্ছন্নকর্মী। আর এরপরই প্রশ্ন জাগে আসলে কীভাবে এত পরিচ্ছন্ন থাকে জাপান?
সহজ উত্তর হচ্ছে- এখানকার বাসিন্দারা দেশকে এভাবেই রাখছে বছরের পর বছর। হিরোশিমা প্রিফেকচারাল গভর্নমেন্টের টোকিও অফিসের সহকারী পরিচালক মাইকো আওয়েন বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চবিদ্যালয় পর্যন্ত ১২ বছর মেয়াদি স্কুল জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শিক্ষার্থীদের দৈনিক সময়সূচীর একটি অংশ।
গার্হস্থ্য জীবনেও পরিবার আমাদের শিক্ষা দেয় যদি আমরা উপকরণ ও আশপাশের স্থান পরিষ্কার না রাখি তাহলে তা আমাদের জন্য কতটা ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। জাপানে স্কুলে এসেই শিক্ষার্থীরা জুতা খুলে লকারে রেখে ট্রেইনার পরে নেয়। একইভাবে, বাইরে পরার জুতা দরজার বাইরে রেখেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তারা।
আওয়েন বলেন, জাপানিরা অন্যের চোখে নিজের খ্যাতি দেখার বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল। আমরা কখনই চাইনা কেউ মনে করুক পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। উৎসবগুলোতেও জাপানিদের পরিচ্ছন্ন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। জাপানের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম ফুজি রক উৎসবে গিয়ে যদি দর্শকরা ময়লার ঝুড়ি দেখতে না পান তাহলে খাবারের খোসা বা অন্যান্য আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে না ফেলে নিজের সঙ্গেই রাখেন।
তাছাড়া এসব স্থানে ধূমপায়ীদেরকে নিজস্ব অ্যাশট্রে বহন করতে বলা হয় ও যেখানে ধূমপান করলে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেখানে ধূমপান করতে নিষেধ করা হয়। প্রতিদিন সকাল আটটা নাগাদ অফিসকর্মী ও দোকানদাররা নিজ নিজ কর্মস্থল ও দোকানের সামনের রাস্তা পরিষ্কার করেন। সেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরা মাসে একবার তাদের নিজ নিজ স্কুলের সামনের রাস্তার ওপর থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করে। তাছাড়া প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতার ঘটনা তো রয়েছেই।
এছাড়াও ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু যা খালি চোখে দেখা যায় না সেগুলো থেকে বাঁচার উপায় তারা ঠিকঠাক মেনে চলে। কেউ যদি ঠাণ্ডা, কাশি বা ফ্লুতে আক্রান্ত হয়, তাহলে অন্যরা যাতে সংক্রমিত না হয় এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি মাস্ক পরিধান করে। ফলে অসুস্থতার কারণে তাদের কর্মদিবসও খুব একটা কাটা যায় না আবার বাঁচে স্বাস্থ্য বিষয়ক খরচ।
শুধু বাড়ি, স্কুল বা রাস্তার কথাতেই এ পরিচ্ছন্নতা সীমাবদ্ধ নয়, জাপানের টাকাগুলো যেন চকচকে থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখে অধিবাসীরা। এটিএম বুথ থেকে কড়কড়ে নোট বের হেওয়ার পর তা এক হাত থেকে অন্য হাতে লেনদেন করে না জাপানিরা । হোটেল, দোকান এমনকি ট্যাক্সিতেও টাকা পরিশোধ করার জন্য ট্রে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
এখন আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, জাপানিরা কেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে এত সচেতন? মূলত, পরিচ্ছন্নতা বৌদ্ধ ধর্মের একটি কেন্দ্রীয় অঙ্গ। যার ধারণা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে চীন ও কোরিয়া থেকে আসে। দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চীন থেকে জাপানে আসা বৌদ্ধধর্মের জেন সংস্করণে পরিচ্ছন্নতা ও রান্নার মতো প্রতিদিনের কাজগুলো আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসাবে বিবেচিত হয়, যা ধ্যান করার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। আওয়েন বলেন, আবর্জনা অবহেলায় রেখে বা নিজেরা অলস থেকে জাপানিরা অন্যদের বিরক্ত করায় বিশ্বাস করে না।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ