বাংলাদেশের কৃষিতে ফল ও সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফলের মাছি পোকা (fruit fly) এক মারাত্মক সমস্যা। সবজি বা ফল যখন একটু বড় হয়ে উঠে ঠিক তখনই মাছির মতো দেখতে এ পোকাটি কোমল ফলের গায়ে ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ফলে ফলটি আর সঠিকভাবে না বেড়ে বিকৃত আকার ধারণ করে থাকে। এতে উৎপাদন কমে যায় এবং বাজারমূল্য পাওয়া যায় না। সাধারণত এ মাছি পোকা কুমড়া জাতীয় বিভিন্ন ফসলে যেমন- লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, কাঁকরোল, করলা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি ফসলে বেশি আক্রমণ করে থাকে। ফলের মধ্যে আম, ডুমুর, লিচু, পেঁপে, পেয়ারা, বড়ই, এভোকেডো, পিচ ইত্যাদি ফলে এ মাছি পোকা দেখা যায়।
এক জরিপে দেখা যায়, কুমড়াজাতীয় ফসল ও আম ফসল উৎপাদনে এ মাছি পোকা বছরে প্রায় ৬৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করে। সাধারণত কৃষকরা ফলের মাছি পোকা দমনের জন্য প্রচুর ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে পরিবেশের ক্ষতির সাথে সাথে কৃষক ও ভোক্তাদের শরীর ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। কীটনাশক ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের আক্রমণে ধীরে ধীরে শরীরে নানা রকম ব্যাধি যেমন- ক্যান্সার, কিডনি সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এছাড়া অতিরক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পোকার অনেক প্রজাতি কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা ধীরে ধীরে অর্জন করে।
এ মারাত্মক সমস্যা সমাধানের জন্য ইদানীং একটি প্রযুক্তি কাজ শুরু করেছে যার নাম আকর্ষণ ও দমন পদ্ধতি (attract and kill)। এ পদ্ধতিতে কখনোই প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক স্প্রে বা কোনো রাসায়নিক প্রদানের অনুমতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখা হয় না। ফলে ফল ও সবজিগুলো বিষাক্তহীন ও নিরাপদ থাকে। ফল সবজি পাড়ার পর রাসায়নিক পরীক্ষায় শূন্য ভাগ রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়। এ পদ্ধতির আরও একটি বিশেষত্ব হচ্ছে মাছি পোকা ছাড়া অন্য উপকারী ও অপকারী পোকা মারা যায় না। অর্থাৎ শুধু ক্ষতিকারক মাছি পোকাই মারা যায়। এতে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।
এ পদ্ধতির সফলতা আরও বেড়ে যায় যখন পুরুষ ও স্ত্রী পোকার জন্য আলাদা ফর্মুলেশনে আকর্ষণ ও দমন পদ্ধতিতে গাছের ডালে বা কাণ্ডে কিছুদূর পর পর সামান্য পরিমাণে নিয়ন্ত্রিতভাবে ফেরোমন মিশ্রিত কীটনাশক বা বেইট দিয়ে পোকা দমন করা হয়। এভাবে স্ত্রী ও পুরুষ পোকা আলাদা আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে তাদের বংশবৃদ্ধি লোপ পায় এবং আক্রমণ কমে যায়। কুমড়া জাতীয় সবজি ফসল যেমন- করলা, লাউ, চালকুমড়া, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা ইত্যাদি মাছি পোকা দমনের জন্য cuetrac প্রযুক্তি এবং zonatrac প্রযুক্তিতে ফলের মাছি পোকা দমন করা হয়। এ প্রযুক্তির প্রধান সুবিধা হচ্ছে-
ক. কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না;
খ. ছোট বা বড় উভয় বাগানেই এটি ব্যবহার করা যায়;
গ. উৎপন্ন পণ্য নিরাপদ ও বিষাক্তহীন হয়;
ঘ. প্রযুক্তিটি এক ফসলে একবার ব্যবহার করলেই হয়;
ঙ. শ্রমিক কম লাগে।
প্রাথমিক মাঠ পরীক্ষায় দেখা যায় যে, আকর্ষণ ও দমন পদ্ধতিতে যে কোনো একটি স্ত্রী বা পুরুষ পোকা দমনের ক্ষেত্রে ৯৭% মাছি পোকা দমন হয়। এবং সম্পূর্ণ ফসলকালীন সময়ে একই অবস্থা বিরাজ করে। আমাদের দেশের দিনাজপুর জেলার বিরল ও বীরগঞ্জ গ্রামের করলা চাষিদের নিয়ে এ পরীক্ষা করে একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে করলা সবজির ক্ষেত্রে বালাইনাশক ব্যবহার না করে এই নবীন প্রযুক্তি cuetrac ব্যবহার করে কৃষকরা সবজির মাছি পোকা প্রায় ৯৭% দমিয়ে রাখতে পেরেছেন। বর্তমানে এ প্রযুক্তির কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য বিএআরআই, ACI Formulation Ltd, EPRC এবং দেশের চাষিদের সাথে একসাথে কাজ করছেন। বিগত মার্চ ২০১৫ মাস বিএআরআইয়ের ড. নূরল আলম, সিএসও করলা ও আম ফসলে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতার পরীক্ষা শুরু করেছেন।
এ প্রযুক্তির উদ্ভাবক হিসেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক রাসেল আইপিএমের সুনাম বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় রাসেল আইপিএমের বিজ্ঞানীরা গত ৫ বছর ধরে ইউরোপ, আফ্রিকা দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় এ নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ফলের মাছি পোকা দমন করে আসছেন। তাদের এ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি যুক্তরাজ্য সরকার অনুমোদন করে ২০১১-২০১২ সনে তাদের কুইনস পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্য সরকার এ মাছি পোকা দমন প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ, নেপাল, তানজানিয়া এবং কেনিয়াতে Innovate UK এর মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা করছেন।
আগামীতে বাংলাদেশের চাষিরা এ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কুমড়াজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। এতে করে ইউরোপে এ সবজি রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইউরোপের বাংলাদেশীরা তাদের সাধের লাউ, চালকুমড়া, শসা, করলা, পটোল, ইত্যাদি সবজিগুলো নিরাপদ ও বিষমুক্ত অবস্থায় পেতে পারেন।
মো. মোসারফ হোসেন
অতিরিক্ত পরিচালক (অব.), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৫আগস্ট২০