পারা ঘাস ক্ষেতে সার প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়

1831

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাণীজ আমিষ যেমন দুধ, মাংস প্রভৃতি উৎপাদনের লক্ষ্যে গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গবাদি পশু প্রতিপালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গবাদিপশুর সুস্বাস্থ্য, জাত উন্নয়ন এবং পশুজাত দ্রব্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা। অথচ অদ্যাবধি আমাদের দেশে পশু খাদ্য উৎপাদনের জন্য স্বতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। শুধুমাত্র মনুষ্য খাদ্য উপজাতসমূহই গবাদি পশুর খাদ্য উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

দেশের জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে চারণভূমি ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। এ দেশে মাথা পিছু জমির পরিমাণ মাত্র ০.২৫ একর। তার উপর বাড়তি জনগণের জন্য বসতবাড়ী, অন্যান্য অবকাঠামো এবং কল-কারখানা স্থাপন করতে আবাদী জমি দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে গবাদিপশুর জন্য সবুজ ঘাস উৎপাদনে আবাদযোগ্য জমির ব্যবহার অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এতদ্বসত্বেও ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির জন্য আমিষ খাদ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস সৃষ্টির জন্য গবাদিপশু পালনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে পশু সম্পদের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পশুসম্পদ উন্নয়ন কর্মকান্ডে গতি সঞ্চার হয়েছে। তাই গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে নানা ধরনের খামার স্থাপনের জন্য জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য পশুপালনের গুরুত্ব এখন সর্বমহলে স্বীকৃত। ইতোমধ্যে দেশে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার স্থাপিত হয়েছে। অথচ ব্যাপক খাদ্যাভাব গবাদি পশুর সার্বিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে এবং প্রজনন, রোগ প্রতিরোধ ও উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ফসল উৎপাদনকে বাধাগ্রস্থ না করে একই আবাদযোগ্য জমি ও বিভিন্ন প্রকার অব্যবহৃত জমি থেকে গবাদিপশুর জন্য খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পশুসম্পদ বিভাগ থেকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে (নিকটস্থ সরকারি পশুসম্পদ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে)। উন্নত জাতের ঘাস চাষের জন্য পতিত জমি, দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময় বা অন্য কোনো ফসলের সাথে আবাদি জমি, নতুন জেগে ওঠা চর, পাহাড়ের ঢাল, সড়ক ও রেল পথের ঢালু এলাকা, সরকারি খাস জমি, উপকূল, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, জমির আইল, বাড়ীর আশে-পাশের অব্যবহৃত জায়গা এবং তুলনামূলকভাবে অলাভজনক ফসলের জমিকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ উদ্দেশ্যে একটি উচ্চ উৎপাদনশীল ঘাস হিসেবে পারা ঘাসের চাষ কৌশল নিয়ে আজকে আলোচনা করা হচ্ছে। স্থায়ী ঘাস হিসাবে পারা অন্যতম। এ ঘাস বিভিন্ন নাম যেমন মহিষ ঘাস, পানি ঘাস ইত্যাদি হিসাবে পরিচিত। এ ঘাস জমিতে চাষের পর মাটিতে লতার মত ছড়িয়ে পড়ে এবং অল্প দিনেই সমস্ত জমিতে বিস্তার লাভ করে। এ ঘাসের উৎপত্তি আমেরিকায় হলেও বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানের আবহাওয়ায় আবাদ বা চাষযোগ্য। জমিতে একবার রোপন করলে কয়েক বছর পর্যন্ত বিনা চাষে ফলন পাওয়া যায়।

জমি নির্বাচন: পারা ঘাস প্রায় সব ধরনের জমি যেমন উঁচু, নিচু, ঢালু, জলাবদ্ধ এমনকি লোনা মাটিতেও চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় প্রায় সর্বত্রই এর ফল বেশ সন্তোষজনক। গাছের নীচে, অধিক স্যাঁতস্যাঁতে, জলাবদ্ধ এবং বন্যা প্লাবিত জমি যেখানে অন্যান্য ফসল মোটেই ভাল জন্মে না সেখানে পারা চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। তবে পারা বেশি শীত সহ্য করতে পারে না। যে সব এলাকায় বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ১০০ সেমি-এর কম সেখানে পারা উৎপাদন ঠিক নয়।

রোপন সময়: বৈশাখ হতে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পারা ঘাস রোপনের উত্তম সময়। কিন্তু জমি ভিজা বা পানি সেচ দেয়ার সুবিধা থাকলে চৈত্র মাসেও এ ঘাস চাষ করা যায় ।

কাটিং: বীজ হিসাবে শিকড়সহ গাছ বা কান্ড ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেক কাটিং বা চারায় ২ বা ৩টি গিটসহ প্রতি ২.৫ একরে ছিটিয়ে বপনের জন্য ১০০০ কেজি দরকার। আর যদি সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়, তাহলে ২.৫ একর প্রতি ১২০০ কেজি কাটিং-এর প্রয়োজন হয়।

জমি চাষ ও রোপন পদ্ধতি: জমির আগাছা নষ্ট করার জন্য জমিতে কমপক্ষে ২-৩টা চাষের প্রয়োজন হয়। জমি ভালমত চাষ এবং আগাছা পরিষ্কার করে এই ঘাস বপন করলে খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় এবং ফলন বেশি হয়। যদি জমি ভিজা থাকে তাহলে চারা মাটিতে ফেলে লাগানো যায়। আর যদি জমিতে পানি থাকে তাহলে কাটিং-এর মাথা (হেলান ভাবে) লাগাতে হবে। সারিবদ্ধভাবে লাগানোর ক্ষেত্রে এক সারি হতে অন্য সারির দূরত্ব ২৪-৩৬ ইঞ্চি এবং এক চারা হতে অন্য চারার দূরত্ব ৬-১২ ইঞ্চি হতে হবে।

সার প্রয়োগ: পারার ক্ষেতে সার প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। পারা দ্রুত বর্ধনশীল এবং বছরে অনেকবার কাটা যায়। এ ঘাসের জন্য সারের চাহিদা নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া। সমতল চাষযোগ্য জমিতে পারা চাষের জন্য জমি প্রস্তুতির সময় প্রতি ২.৫ একরে ১০/১২ মে.টন গোবর সার এবং ৮৫ কেজি টিএসপি সার দিতে হবে। ঘাস লাগানোর ২/৩ সপ্তাহ পর প্রতি ২.৫ একরে ৮৫ কেজি ইউরিয়া দিতে হবে। তাছাড়া প্রতি বার ঘাস কাটার পর ৮৫ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ভাল হয়। পানি সেচ কার্যক্রম ঃ এ ঘাসের জমি সব সময় স্যাঁতস্যাঁতে বা ভিজা রাখতে পারলে ভাল হয়। তাই বছরের শুকনা মৌসুমে পানি সেচ করা প্রয়োজন।

ঘাসের যত্ন: পারা ঘাসের তেমন একটা যতেœর প্রয়োজন হয় না। তবে সঠিক সময়ে ঘাস কাটলে এবং পানি সেচ ও সার প্রয়োগ করতে পারলে এই ঘাস পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হয়। প্রতিবার ঘাস কাটার পর জমিতে হালকা চাষ দিয়ে মাটি নরম করে দিতে হবে। ভালভাবে আগাছা পরিষ্কার করে প্রতি ২.৫ একরে ৮৫ কেজি এমোনিয়াম সালফেট সার দিলে প্রত্যাশানুযায়ী ফলন পাওয়া যায়। সাথী ঘাস চাষ ঃ যদি পারা ঘাস জলাবদ্ধ জমিতে চাষ করা হয় তাহলে কোনো প্রকার লিগুম ঘাসের সাথে চাষ করা যায় না। তবে উঁচু জমিতে চাষ করা হলে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের লিগুম ঘাস যেমন সেন্ট্রোসীমা, নিরাট্রো ইত্যাদি সাথী হিসাবে চাষ করা যায়।

ঘাস কাটার নিয়ম ও ফলন: পারা ঘাস লতিয়ে যায় বলে অল্প দিনের মধ্যেই জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। ঘাস রোপনের তিন মাস পর প্রথম বার ঘাস কাটা যায় অথবা গবাদি পশুকে চরিয়ে খাওয়ানোর উপযোগী হয়। বৎসরে প্রায় ৮/১০ বার ঘাস কাটা যায়। প্রয়োজনানুযায়ী সার ও পানি সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে বৎসরে প্রতি ২.৫ একর ৯০-১০০ মে. টনের মত সবুজ ঘাস পাওয়া যায়।

ঘাস খাওয়ানোর নিয়ম: গরু মাঠে চরিয়ে কাঁচা ঘাস হিসাবে পারা খাওয়ানো যেতে পারে। তবে মাঠ থেকে কেটে এনে খাওয়ানোই উত্তম। এক্ষেত্রে টুকরা টুকরা করে কেটে খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো ভালো। যদি একটি গাভীর দৈহিক ওজন ১০০ কেজি হয়, তাহলে এর দৈনিক খাদ্য তালিকায় ১.০ কেজি দানাদার খাদ্য ১.৪০ কেজি শুকনা খড় এবং প্রায় ৪.০ কেজি পারা ঘাস সরবরাহ করা যেতে পারে। তবে যদি এই গাভীকে (১০০ কেজি ওজনের) ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় খাওয়ানো হয়, সেক্ষেত্রে ০.৫ কেজি দানাদার খাদ্য ১.০ কেজি শুকনা খড়, ২.৫-৩. কেজি পারা ঘাস এবং ২-২.৫ কেজি ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় প্রতিদিন সরবরাহ করা যেতে পারে। এই হিসাব অনুযায়ী গাভীর শারীরিক ওজন অনুপাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করে এর অর্ধেক সকালে এবং বাকী অর্ধেক বিকেলে খাওয়াতে হবে। এর সাথে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

সংরক্ষণ: পারা ঘাস শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তবে সাইলেজ হিসাবে সংরক্ষণ করাই উত্তম। গাভীর দুধ উৎপাদন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য কাঁচা ঘাসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কাঁচা ঘাসের সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া মাংস ও দুধ উৎপাদন বাড়ানো প্রায় অসম্ভব। সেদিক বিবেচনা করলে উচ্চ ফলনশীল ঘাস হিসাবে পারা ঘাস বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চাষ করা যেতে পারে। আমাদের জমির স্বল্পতা আছে সত্য, তবে অব্যবহৃত জায়গায় পরিকল্পনা মাফিক ঘাস চাষের কৌশল করলে ঘাসের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এ জাতীয় উন্নতমানের উচ্চফলনশীল ঘাস গবাদিপশুকে সঠিক নিয়মে খাওয়ানো হলে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে যা দেশের আমিষ ঘাটতি লাঘবের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং অন্য দিকে দুধ আমদানিতে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে তা সাশ্রয় হবে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৭মে২০