পাহাড়ের চূড়ায় ড্রাগন চাষ করে লাখপতি

434

ড্রাগন

যেখানে পানির সংকট মোকাবেলায় মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে যুদ্ধ করছে। সেখানে ফলদ বাগান সৃষ্টি কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই অসাধ্যকে সাধন করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪শ’ ফুট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় ড্রাগন চাষ করে আশা জাগিয়েছেন এক প্রান্তিক চাষি। শুধু ড্রাগন চাষই নয়, মহালছড়ির ধুমনীঘাট এলাকায় ৪০ একর টিলা ভূমিতে প্রচলিত, অপ্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় সব ধরনের ফলদ গাছ সৃষ্টি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।

গল্পের শুরুটা ২০১৬ সালে। দেশি-বিদেশি ৫০০ আমের চারাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ গাছের চারা রোপণের মধ্যদিয়ে শখের বসে শুরু করেন বাগান। এ শখই মাত্র তিন বছরে তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে। খাগড়াছড়িতে প্রচলিত, অপ্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় ফলদ বাগান সৃষ্টি করে জাতীয় পর্যায়ে পেয়েছেন সফল ফলদ বাগানীর স্বীকৃতি। জাতীয় পর্যায়ে প্রথম হয়ে পাহাড়কে নতুনভাবে পরিচিত করেছেন হ্লাশিং মং চৌধুরী। চলতি বছরের ১৮ জুন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে তিনি এ স্বীকৃতি লাভ করেন।

২০১৭ সালের শুরুর দিকে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের’ অধীনে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। শুরুতে প্রণোদনা হিসেবে পাওয়া ৫০০ ড্রাগন গাছের চারা দিয়ে শুরু করেন। শুরুতেই পানি সংকটের মুখে পড়লেও সে প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছেন। বছর ঘুরতেই তার বাগানে ড্রাগন গাছের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই সহস্রাধিক। বর্তমানে তার বাগানে ২ হাজার ২শ’ ড্রাগন গাছে ঝুলছে ফল। সম্প্রতি মহালছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৭ কিমি দূরে মহালছড়ি-সিন্ধুকছড়ি সড়কের পাশে ধুমনীঘাট এলাকার ‘তরু-বীথি মিশ্র ফলদ বাগানে’ ড্রাগন সাফল্যের কথা জানান সফল চাষি হ্লাশিং মং চৌধুরী।

বছর না ঘুরতেই ২০১৮ সালের শেষ দিকে লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। চলতি বছরের শুরুতে আরও লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রির কথা জানিয়ে এ বছর ড্রাগন বিক্রি থেকে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা আয় হবে বলে জানান তিনি। হ্লাশিং বলেন, প্রতি কেজি ৪৫০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। একেকটি ড্রাগন গাছ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ফলন দেবে। দাম কিছুটা বেশি হলেও কোন সমস্যা হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকেই বাগান থেকেই ফল কিনে নিয়ে যায়।

নিবিড় যত্ন ও নিয়মিত সূর্যের আলো পাওয়ায় পাহাড়ের চূড়ায় ড্রাগনের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে দাবি এ কৃষকের। প্রতিটি গাছ থেকে ৪-৫ কেজি ড্রাগন ফল পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪শ’ ফুট উঁচুতে হওয়ায় সেচ নিয়ে বিপত্তি ঘটে। বর্ষায় সেচ দেওয়ার দুশ্চিন্তা না থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে বিপাকে পড়তে হয়। এমনটাই জানিয়েছেন হ্লাশিং মং চৌধুরী। প্রথম দিকে শ্রমিক দিয়ে ঝিরি থেকে পানি তুললেও পরবর্তীতে পানির সংকট মোকাবেলায় হর্টিকালচার সেন্টারের সহায়তায় বসানো হয়েছে ৩ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার পানির ট্যাংক।

নিজের এ সাফল্যের জন্য খাগড়াছড়ি হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকে কৃতিত্ব দিয়ে বলেন, ‘তার উৎসাহে এবং হর্টিকালচার সেন্টার থেকে পাওয়া প্রণোদনায় আমি এ পাহাড়ের চূড়ায় ড্রাগন চাষ করেছি।’ বর্তমানে তার বাগানে আরও প্রায় ১ হাজারের মতো ড্রাগন গাছ রোপণের প্রস্তুতি চলছে। তার এ ড্রাগন বাগানে প্রতিদিন ৮-১০ জন নিয়মিত শ্রমিক কাজ করে জানিয়ে হ্লাশিং মং চৌধুরী বলেন, ‘এতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে।’

পাহাড়ের চূড়ায় ড্রাগন চাষে সফল হ্লাশিং মং চৌধুরী তিন বছরের মধ্যেই বাগানীদের আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে দেখে অনেকেই মিশ্র ফলদ বাগানে উৎসাহী হচ্ছেন জানিয়ে খাগড়াছড়ি হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘হ্লাশিং মং চৌধুরী একজন মডেল কৃষক। কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় নিজের জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তার এ সাফল্য স্থানীয় কৃষকদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা।’

খাগড়াছড়ির পাহাড়ি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রশিদ আহমেদ বলেন, ‘পাহাড়ের এতো উঁচুতে ড্রাগন চাষের নজির এটাই প্রথম। সব ধরনের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে পাহাড়ের চূড়ায় ড্রাগন চাষের বিপ্লব ঘটিয়েছেন হ্লাশিং মং চৌধুরী। পানি সংকট আর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে ড্রাগন চাষে লাভের মুখ দেখবে কৃষক।’

ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ