পুকুরে অক্সিজেনের উৎস, স্বল্পতা ও প্রতিকার

2552

maxresdefault
মাছ পুকুরে যদি অক্সিজেনের পরিমাণে হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে তাহলে মাছের সাধারণ উৎপাদন ব্যাহত হয়। সেজন্য আমাদের উচিৎ মাছ চাষের পুকুরে যেন কোন অবস্থাতেই অক্সিজেনের স্বল্পতা সৃষ্টি না হয়।

পানিতে যদি অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় তাহলে মাছের বৃদ্ধির হার ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় । ফলে মাছ সহজেই পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত ও রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

আরও পড়ুনঃ চাকা ও হরিণা চিংড়িতে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন গবেষকরা

অক্সিজেনের প্রত্যাশিত সীমা
পুকুরে অক্সিজেন মাত্রা ৩-৫ মিলি গ্রাম/ লিটার থাকলে পুকুরটি অনুৎপাদনশীল এবং ভাল উৎপাদনের জন্য পুকুরে ৫ মিলি গ্রাম/লিটার এর বেশি অক্সিজেন থাকতে হবে। শীত প্রধান অঞ্চলের মাছের চেয়ে গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের মাছের স্বল্প মাত্রার অক্সিজেন সহনশীল ক্ষমতা বেশি।

ভালো উৎপাদনের জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান ৫ মিলি গ্রাম/লিটার এর বেশি প্রয়োজন। পুকুরে ১-৩ মিলিগ্রাম/লিটার দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকলে মাছের বৃদ্ধি ও খাদ্য গ্রহনের হার কমে যায়। পুকুরে অক্সিজেন ০.৩-০.৮ মিলিগ্রাম/ লিটার হলে মাছের জন্য মারাত্মক হয়ে থাকে। মাছের পোনার জন্য ১৪ মিলিগ্রাম/লিটার এর বেশি ক্ষতিকারক। সেক্ষেত্রে পোনা মাছের গ্যাস ব্যাবল রোগের সৃষ্টি হয়।

পুকুরের পানিতে যদি অক্সিজেনের মাত্রা ১ মিলির কম হয় তাহলে মাছের মৃত্যু হতে পারে।
পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ যদি ৫ মিলি এর কম হয় তাহলে মাছ মরে না গেলেও মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
তবে মাছ চাষের পুকুরে পানিতে যদি অক্সিজেনের মাত্রা ৫ মিলি গ্রাম/ লিটার বা তার বেশি হয় তাহলে মাছ চাষের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয় ।
পুকুরে অক্সিজেনের উৎস
মাছ চাষের পুকুরে ফাইটোপ্লাংক্টনের সালোক সংশ্লেষণের দ্বারা পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও বায়ুমন্ডলের অক্সিজেন দ্রবীভূত হওয়ার ফলেও পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

১) সালোক সংশ্লেষণ
গাছের ছায়া ও প্লাংক্টনের ব্লুমও সূর্যের আলোকে পুকুরের গভীরে প্রবেশে বাধা দেয় ফলে সালোক সংশ্লেষণের মাত্রা কমে যায়। এমনকি পুকুরে ফাইটো প্লাংক্টনের পরিমান বেশি হলে পুকুরের ১.৫-২ মিটার গভীরতায় অক্সিজেন শূন্য মিলি গ্রাম/লিটার এ নেমে যায়। সুতরাং পুকুরে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াই উৎপন্ন অক্সিজেনই হলো পুকুরের প্রধান উৎস্য।

সালোক সংশ্লেষণ বিক্রিয়াঃ সূর্যের আলোক শক্তি + 6CO2 + 6H2O-C6H12O6 + 6O2

২) বাতাস থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন
বায়ু মন্ডলের ২১% অক্সিজেন অর্থাৎ বায়ুতে অক্সিজেন থাকে ২০০০০০ মিলি গ্রাম / লিটার অপর দিকে পানিতে থাকে ৫-১৪ মিলি গ্রাম/লিটার। ফলে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় এবং পানির উপরিভাগে বাতাস প্রবাহের ফলে পানিতে স্বল্প পরিমানে অক্সিজেন দ্রবীভূত হয়। এ ছাড়া বায়ু মন্ডলের অক্সিজেনের চাপের কারনে পানিতে অক্সিজেন দ্রবীভূত হয়। বায়ু মন্ডলের অক্সিজেনের চাপ ও পানির পৃষ্ঠের অক্সিজেনের চাপ সমান হলে আর অক্সিজেন পানিতে দ্রবীভূত হতে পারে না।

লবনাক্ততাঃ- পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে অক্সিজেন দ্রবীভূত হওয়ার হার কমে যায় ।
তাপমাত্রাঃ- পুকুরের পানির তাপমাত্রা যদি ঠিক না থাকে তাহলে অক্সিজেনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বায়ু মন্ডলীয় চাপঃ- অক্সিজেনের হার কমে যাওয়ার আর একটি অন্যতম কারণ হল বায়ু মন্ডলের চাপ কমে যাওয়া।
নিম্নে এক থেকে দেড় মিটার গভীরতার পুকুরে অক্সিজেন প্রাপ্তি ও ব্যবহার বা খরচের হিসাব দেয়া হলো–

প্রাপ্তি

১) ফাইটো প্লাংক্টনের সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে= ৫–২০ মিলিগ্রাম / লিটার।
২) ব্যাপন (Diffusion) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে = ১–৫ মিলিগ্রাম/ লিটার।

ব্যবহার বা খরচ
ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয় = ১–৫ মিলিগ্রাম / লিটার ।
প্লাংক্টনের শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহৃত হয় = ৫–১৫ মিলিগ্রাম / লিটার ।
মাছের শ্বাস- প্রশ্বাসে ব্যবহৃত হয় = ২–৬ মিলিগ্রাম / লিটার ।
কাদার প্রাণীকূলের শ্বাস-প্রশ্বাসে = ১–৩ মিলি গ্রাম / লিটার ।

সুতরাং দেখা যায় প্লাংক্টন ও মাছ পানি থেকে যে পরিমান অক্সিজেন গ্রহণ করে তা পুকুরে ফাইটো প্লাংক্টনের মাধ্যমে সংঘটিত সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে পূরণ হয়ে থাকে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমান সম্পৃক্তি সীমার নিচে থাকলে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বায়ু মন্ডল থেকে অক্সিজেন পানিতে দ্রুবিভূত হয়।

অক্সিজেন স্বল্পতা
পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতা নিম্নে উল্লেখিত বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভরশীল

১) গরম, মেঘাচ্ছন্ন ও বাতাসহীন আবহাওয়া
এরুপ আবহাওয়া আমাদের দেশে জুন থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকে। এ সময় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা তার বেশি থাকে ফলে পানি উত্তপ্ত হয়। গরম পানির অক্সিজেন ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের দেশের বেশির ভাগ পুকুর বা জলাশয়ে ২ মিলিগ্রাম/লিটার বা তার কম পরিমান অক্সিজেন থাকে।

মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া সূর্যের আলো থাকে না বিধায় সালোক সংশ্লেষণ মাত্রা কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায় ফলে অক্সিজেন উৎপাদনও কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। বাতাস না থাকলে পুকুরের পৃষ্ঠের পানির উত্তালতা কমে যায়।এতে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বাতাস থেকে পানিতে অক্সিজেন দ্রাব্যতা বাধাপ্রাপ্ত হয় ।

অপর দিকে গরমের সময় মাছের জৈবিক ক্রিয়া বৃদ্ধি পাওয়ায় অক্সিজেন চাহিদা বৃদ্ধি পায়। মাছ শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রানী বিধায় তাদের শরীরের তাপমাত্রা ও ক্রিয়াকলাপ পানির তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল। এছাড়া গ্রীষ্মের শেষের দিকে পুকুর বা জলাশয়ে মাছের পরিমান বেশি থাকে।

২) ফাইটো প্লাংক্টনের হঠাৎ মৃত্যু বা অ্যালগাল ব্লুমের ধ্বংসের কারণ
মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় সূর্যের আলোর স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত পুষ্টি বা পুষ্টির স্বল্পতা অথবা ফাইটোপ্লাংক্টনের বয়স বৃদ্ধি পাওয়ায় ফাইটো প্লাংক্টনের হঠাৎ মৃত্যু ঘটে থাকে। এই মৃত ফাইটোপ্লাংক্টন বা অ্যালজির পচনের জন্যও অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া বিশেষকরে রাতের সময় ঘন ফাইটোপ্লাংক্টন ব্লুম শ্বাস- প্রশ্বাসের জন্য পানি থেকে সকল অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। এসব কারণে পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। ব্লুম ধ্বংস হলে পানির রং কালো হয়ে যায় অথবা রাত্রি শেষে পানি পরিস্কার হয়ে যায়।

৩) পুকুর বা জলাশয়ে তাপের স্তরীবিন্যাস
বেশি গভীর পুকুর অর্থাৎ গভীরতা ৮ ফুট বা তার বেশি হলে ঐসব পুকুরে উপরের ৪–৬ ফুট পর্যন্ত পানি দ্রুত উত্তপ্ত হয়। এই উত্তপ্ত পানিতে অক্সিজেন কম থাকে। গভীরের ঠান্ডা পানির তুলনায় উপরের স্তরের অর্থাৎ গরম পানির ঘনত্ব হালকা ও ওজনে কম হয় ফলে তা নিচের ঠান্ডা ও ভারী পানির সাথে মিশ্রিত হতে পারেনা। পুকুরের তলার পানি ঠান্ডা ও ভারী বিধায় পানি স্থির থাকে। এ ছাড়া পুকুরের তলায় ব্যাক্টেরিয়ার দ্বারা পচনশীল জৈব পদার্থ অক্সিজেনবিহীন অবস্থায় পচে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি করে।

এভাবে পুকুরের গভীর অংশের পানি তাপের স্তরীবিন্যাসের কারনে অক্সিজেনবিহীন অবস্থায় থাকে। এ অবস্থায় হঠাৎ মুসলধারে বৃষ্টি (২-৩ ইঞ্চি বা তার বেশি) হলে পুকুরের উপরের স্তরের পানি হঠাৎ বেশি ঠান্ডা হয় উপরের এই ঠান্ডা পানি পুকুরের গভীর অংশে চলে যায় এবং তলদেশের অক্সিজেনবিহীন পানি উপরে উঠে আসে অথবা উপরের ও নিচের পানির মিশ্রন ঘটে। এভাবে মাছ চাষের পুকুরে হঠাৎ অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়।

৪) জৈব বর্জ্য পদার্থের পচনের ফলে
পুকুরে গ্রীষ্মকালে বা তার পরবর্তী সময়ে মোট মাছের পরিমান বেশি থাকে বিধায় পুকুরে তখন বর্জ্য ও জৈব পদার্থ (যেমনঃ অ্যামোনিয়া , নাইট্রাইট, মাছের মল ও অতিরিক্ত খাদ্যের অংশ) ইত্যাদির পরিমান বৃদ্ধি পায়। এই বর্জ্য ও জৈব পদার্থ পচতে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এছাড়া এই বর্জ্য ও জৈব বর্জ্যের পচনের ফলে পুকুরে পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। এতে করে পুকুরে প্লাংক্টন ব্লুমের সৃষ্টি হয় । এরুপ অবস্থায়ও পূর্বের আলোচনা মোতাবেক পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়।

৫) জৈব সার
পুকুরে অধিক জৈব সার যেমনঃ গোবর, মুরগীর লিটার ইত্যাদি ব্যবহার করলে তাদের পচনে অক্সিজেন প্রয়োজন হয় । ফলে তখন মাছ চাষের পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়।

৬) পানির সরবরাহ বন্ধ করলে
নিবিড় মাছ চাষের পুকুরে পানির প্রবাহ কমিয়ে দিলে বা বন্ধ করলে পুকুরে অক্সিজেন দ্রুবিভূত হওয়ার হার কমে যায়। ফলে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়।

৭) শীত কালে তাপমাত্রা কমে গেলে
শীত কালে হঠাৎ তাপমাত্রা কমে গেলে মাছ খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত খাদ্য ও পুকুরের তলার বর্জ্য পদার্থের পচনে পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়।

প্রতিকার
১) অতিরিক্ত রাসায়নিক, জৈব সার ও খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
২) পুকুরে ফাইটো প্লাংক্টনের পরিমান নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৩) ফাইটো প্লাংক্টন ব্লুম ধ্বংসের (Bloom Crash) পর পানি কালো হলে বা পরিস্কার হয়ে গেলে পরিমানমত চুন দিয়ে পরবর্তীতে টি এস পি সার প্রয়োগ করে পানি পুনঃরায় পরিমিত পরিমানে সবুজ করতে হবে।
৪) এয়ারেটর ব্যবহার করে পুকুরে অক্সিজেনের পরিমান বৃদ্ধি করা যায়। পুকুর ৮ ফুটের বেশি গভীর হলে তাপীয় স্তরী বিন্যাস হয়ে থাকে এজন্য পুকুরে দুপুরের পর এয়ারেটর চালু করতে হবে।
৫) পুকুরের ২০% পরিমান পানি বের করে দিয়ে নতুন পানি প্রবেশ করালে অক্সিজেন বৃদ্ধি পায়।
৬) কৃত্রিমভাবে পাম্প মেশিন দিয়ে বা লোক পুকুরে নামিয়ে বাঁশ বা পাতিল দিয়ে পুকুরের পানি পিটিয়ে স্রোতের সৃষ্টি করলে পুকুরে অক্সিজেন বৃদ্ধি পাবে।
৭) পুকুরে যাতে অতিরিক্ত মাছ মজুদ করা না হয় সে বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে।
৮) পুকুরে বিশেষ করে নিবিড় বা আধানিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষের পুকুরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের জন্য নিয়মিতভাবে দুপুরের পর ঠান্ডা পানি প্রবেশ করাতে হবে ।
৯)পুকুরে অক্সিজেনের পরিমান বেশি হলে পুকুরে অপেক্ষাকৃত বেশি গরম পানি প্রবেশ করাতে হবে।

১০) সর্বোপরি ব্যাবস্থাপনায় সর্বদা সর্তক থাকতে হবে যাতে পুকুর বা জলাশয়ের অক্সিজেন স্বল্পতার কারন সৃষ্টি না হয়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২০মার্চ২০