পুকুরে মাছের সাথে মুক্তা চাষ করে মাছ চাষের পাশাপাশি মুক্তা থেকেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। সাধারণত মুক্তা তৈরি হয় যখন কোনও বহিরাগত বস্তু যেমন বালির দানা, কীট ইত্যাদি কোনভাবে একটা ঝিনুকের দেহে প্রবেশ করে এবং ঝিনুক তাকে পরিত্যাগ করতে পারে না ও পরিবর্তে তার উপর স্তরে স্তরে একটি চকচকে আস্তরণ তৈরি করে। আসুন জেনে নেই পুকুরে মাছের সাথে মুক্তা চাষে আমদের করণীয় সম্পর্কে-
মুক্তা চাষের পদ্ধতিঃ
সাধারণত মিঠা পানির মুক্তা চাষে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে হয়ে থাকে। সেগুলি নিচে দেওয়া হল-
ঝিনুক সংগ্রহ
অস্ত্রোপচারের আগের প্রস্তুতি
অস্ত্রোপচার
অস্ত্রোপচারের পরের যত্ন
জলাশয়ে চাষ
মুক্তা বের করা
ঝিনুক সংগ্রহঃ
সাধারণত প্রকৃতি তথা পুকুর নদী ইত্যাদি থেকে সুস্থ ঝিনুক সংগ্রহ করা হয়। ওগুলো হাতে করে সংগ্রহ করে বালতিতে বা পানিভর্তি পাত্রে রাখা হয়। মুক্তা চাষের জন্য ব্যবহৃত আদর্শ ঝিনুকের আকার সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত ৮ সেমির বেশি হবে।
অস্ত্রোপচারের আগের প্রস্তুতিঃ
সংগ্রহ করা ঝিনুকগুলিকে অস্ত্রোপচারের আগে দুই থেকে তিনদিন বন্দী দশায় গাদাগাদি করে পুরোনো কলের পানি লিটার প্রতি একটি ঝিনুকের অনুপাতে রাখতে হয়। এই অস্ত্রোপচার-পূর্ববর্তী পদ্ধতিটি চালান হয় অ্যাডাক্টার পেশিগুলোকে দুর্বল করার জন্যে, যা অস্ত্রোপচারের সময় ঝিনুকগুলোকে সহজে নাড়াচাড়ায় সাহায্য করে।
ঝিনুকের অস্ত্রোপচারঃ
সাধারণত অস্ত্রোপচারের স্থান বিশেষে স্থাপন তিন রকম হয়, যথা ম্যান্টল গহ্বর, ম্যান্টল কোষকলা ও যৌনগ্রন্থীয় স্থাপন। অস্ত্রোপচার দ্বারা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রধান বস্তুগুলি হচ্ছে পুঁতি বা কেন্দ্রকণা, যেগুলো ঝিনুকের খোলা বা অন্য কোনও চুনযুক্ত বস্তুর দ্বারা গঠিত হয়।
ম্যান্টল গহ্বর স্থাপন–এই পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রাণীটির দুটি কপাট খুলে ও খোলার সামনের দিকে থেকে ম্যান্টলকে সাবধানে আলগা করে গোলাকৃতি(৪-৬ মিমি ব্যাসের) বা পূর্বনির্দিষ্ট ধরনের পুঁতি ম্যান্টল গহ্বরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। উভয় কপাটের ম্যান্টল গহ্বরেই স্থাপন করা চলে। পূর্বপরিকল্পিত ধরনের পুঁতি স্থাপনের সময় যত্ন নেয়া হয় যাতে ডিজাইন করা দিকটি ম্যান্টলের দিকে মুখ করে থাকে। পুঁতিটিকে যথাস্থানে রাখার পর ম্যান্টলকে কেবল খোলসের গায়ে ঠেলে দিলেই স্থাপনের দরুন উৎপন্ন ফাঁকা জায়গাগুলি ভরাট হয়ে যায়।
ম্যান্টল কোষকলা স্থাপনঃ
সাধারণত ঝিনুকগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে দাতা এবং অপরটি হল গ্রহীতা ঝিনুক। এই প্রক্রিয়ার প্রথম কাজ হল গ্রাফ্ট বা জোড় তৈরি করা (ধাত্র কোষকলার ছোট ছোট টুকরো)। এটা করার জন্য একটা দাতা ঝিনুক থেকে একটা ম্যান্টল ফিতে তৈরি করা হয় (ঝিনুকের পেটের দিকের ম্যান্টলের একটি ফালি), যে ঝিনুকটিকে এ কাজের জন্য মেরে ফেলা হয় এবং ওই ফিতেটি ছোট ছোট (২- ২মিমি) টুকরায় কাটা হয়।
স্থাপন শুধু গ্রহীতা ঝিনুকে করা হয়, যা দুই ধরনের হয়, যথা কেন্দ্রবিহীন ও কেন্দ্রযুক্ত (নন নিউক্লিয়েটেড ও নিউক্লিয়েটেড)। প্রথমটিতে ঝিনুকের পেটের দিকে অবস্থিত পস্টিরিয়র প্যালিয়াল ম্যাণ্টলের ভিতরের দিকে তৈরি করা পকেট বা গহ্বরে কেবল জোড়ের টুকরোগুলিকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
কেন্দ্রযুক্ত পদ্ধতিতে, একটি জোড়ের টুকরো ও সেই সঙ্গে একটি ছোট কেন্দ্রকণা (২ মিমি ব্যাসের) গহ্বরে ঢোকান হয়। দুটো পদ্ধতিতেই সাবধানতা নেওয়া হয় যাতে জোড় বা কেন্দ্রকণা পকেট থেকে বেরিয়ে না আসে। দুটি কপাটের ম্যান্টলের ফিতেতেই স্থাপন করা যায়।
যৌনগ্রন্থীয় স্থাপনঃ
এই পদ্ধতির জন্যও গ্রাফট বা জোড় (ম্যান্টল টিস্যু পদ্ধতিতে বর্ণিত) তৈরি করতে হয়। প্রথমে ঝিনুকের যৌনগ্রন্থির ধারে কাটতে হয়। তারপর যৌনগ্রন্থিটিতে একটা জোড় এবং তার সাথে একটা কেন্দ্রকণা (২-৪ মিমি ব্যাসের) এমনভাবে প্রবেশ করান হয় যাতে জোড় এবং কেন্দ্রকণা নিবিড়ভাবে পরস্পর সংলগ্ন থাকে। এমনভাবে যত্ন নেওয়া হয় যাতে কেন্দ্রকণাটি জোড়ের বাইরের এপিথেলিয়াল স্তরের সাথে লেগে থাকে এবং অস্ত্রোপচারের সময় অন্ত্র কেটে না যায়।
মুক্তা অস্ত্রোপচারের পরের যত্নঃ
স্থাপন করা ঝিনুকগুলি অস্ত্রোপচারের পরে যত্ন করার জায়গায় নাইলনের ব্যাগে ১০দিন রাখা হয়, অ্যান্টিবায়োটিক এবং প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে। ইউনিটগুলি প্রতিদিন পরীক্ষা করা হয় এবং মরা ঝিনুক এবং যেগুলো কেন্দ্রকণাকে প্রত্যাখ্যান করে সেই ঝিনুকগুলিকে বার করে নেয়া হয়।
জলাশয়ে মুক্তার চাষঃ
অস্ত্রোপচারের পরের যত্নের পর স্থাপন করা ঝিনুকগুলিকে জলাশয়ে ছাড়া হয়। ঝিনুকগুলিকে নাইলনের ব্যাগে রাখা হয় (এক-একটা ব্যাগে দুটো করে) এবং বাঁশের বা পিভিসি পাইপ থেকে ঝুলিয়ে জলাশয়ে ১ মি গভীরতায় রাখা হয়। ১ হেক্টরে ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ ঝিনুক রেখে চাষ করা হয়। জলাশয়ে মাঝে মাঝে জৈব ও অজৈব সার দেওয়া হয় যাতে প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদন অব্যাহত থাকে। চাষের ১২-১৮ মাস সময়কালের মধ্যে মাঝেমাঝেই ঝিনুকগুলিকে যাচাই করে মরা ঝিনুক বার করে দেওয়া এবং ব্যাগগুলিকে পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
মুক্তা তোলাঃ
চাষের সময়ের শেষে ঝিনুকের ফসল তোলা হয়। ম্যান্টল কোষকলা বা যৌনগ্রন্থি পদ্ধতিতে জ্যান্ত ঝিনুক থেকে মুক্তা বের করা সম্ভব হলেও ম্যান্টল গহ্বর পদ্ধতিতে ঝিনুকগুলিকে মেরে ফেলতে হয়। বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার করে স্থাপন করা পদ্ধতির ফলে যে মুক্তাগুলো পাওয়া যায় তা হল ম্যান্টল গহ্বর পদ্ধতিতে খোলের গায়ে লেগে থাকা অর্ধ গোলাকৃতি ও প্রতিকৃতি মুক্তো; ম্যান্টল কোষকলা পদ্ধতিতে না লেগে থাকা ছোট অসমান বা গোল মুক্তো এবং যৌনগ্রন্থি পদ্ধতিতে না লেগে থাকা বড় অসমান বা গোল মুক্তো।
পুকুরেই মাছের সাথে মুক্তা চাষঃ
মুক্তা একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। ঝিনুকের ন্যাকার গ্রন্থি হতে নির্গত রস জমে যে পদার্থ তৈরি হয় তা হচ্ছে মুক্তা। দেশের বিলে-ঝিলে ও উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর ঝিনুক রয়েছে। ওই ঝিনুক ব্যবহার করে মুক্তা চাষ ও উৎপাদন বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর নূন্যতম কোন উদ্যোগ নেই। সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই পরিকল্পিতভাবে মুক্তা চাষ ও উৎপাদন করে প্রতিবছর দেশীয় চাহিদা পূরণ করা ছাড়াও হাজার হাজার কোটি টাকা মুক্তা রফতানি করা সম্ভব। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
ঝিনুকের মধ্যে একটি বিশেষ উপাদান থাকে যাকে ন্যাকার বলে। ঝিনুকের শেল এর মেন্টেলের মসৃন পর্দাকে নেক্রিয়ার লেয়ার বলা হয়, সেখানে নির্গত রস জমেই তৈরি হয় মুক্তা। এক বিঘা পুকুরের পানিতে বাংলাদেশে সাধারণত ২ হাজার ঝিনুক মুক্তা চাষের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।
জানা যায়, বাংলাদেশে যে জাতের ঝিনুক আছে তাতে সাধারণত গোলাপী রং এর মুক্তা চাষ করা যাবে এবং সারা বিশ্বে গোলাপী মুক্তার চাহিদা ব্যাপক। বাংলাদেশের কক্সবাজার মহেশখালী ও সেন্টিমার্টিন এলাকাকে অতীতে পার্ল বা মুক্তার বিছানার বলা হতো ওইসব এলাকা চাষের ঝিনুকে ভরপুর রয়েছে এখনো। দেশের সবখানের পুকুর ছাড়াও ওইসব সহ উপকূলীয় এলাকায় ঝিনুকের মাঝে মুক্তা চাষের উদ্যেগ নেয়া যেতে পারে সরকারিভাবে। তবে শুধু উদ্যোগ নিলেই হবে না, যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে মুক্তা চাষ ও উৎপাদনে। সেই জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে মুক্তা চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, উদ্ধুদ্ধ করতে হবে মৎস্যচাষিদের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি দেশে পরিকল্পিতভাবে মাছের সাথে মুক্তার চাষ ও উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আমাদের দেশ লাভবান হবে। এই পদ্ধতিতে মাছের সাথে মুক্তা চাষ করে অনেক চাষিরাই স্বাবলম্বী হতে পারবেন।