ঢাকা: দেশের আপামর মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুড়ো দুধের ওপর নির্ভরশীলতা নয় বরং খাঁটি তরল দুধের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং দুগ্ধখামারিদের স্বার্থরক্ষার প্রতি নজর দিতে হবে।
বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দুগ্ধ খামারিদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ফিল্ড মিল্ক পাউডার (এফএমপি) বা গুড়োদুধের আমদানিতে শুল্ক কমানোর মধ্য দিয়ে দেশীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারি খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাই শুল্ক হ্রাস নয় বরং বিদ্যমান শুল্ক বহাল রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ এন্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপের দাবি তাদের।
মঙ্গলবার (১২ জুন) জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
বিডিএফএ সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, দুগ্ধ উৎপাদনে সাধারণ খামারিরা যখন পারদর্শীতা দেখাতে শুরু করেছেন, আমদানি নির্ভরতা যখন কমে আসতে শুরু করেছে এবং দুগ্ধ উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে সরকার যখন ইতিবাচক উদ্যোগ নিচ্ছেন, এমনকি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ প্রকল্প (৫ হাজার কোটি টাকার) বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে- তখন গুড়াদুধের ওপর শুল্ক হ্রাস সরকারের নীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আর এ প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে সারাদেশের লাখো খামারির সর্বনাশ হবে, এখাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।
তিনি বলেন, দুগ্ধ উৎপাদনকারি এলাকা হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ, পাবনা, সাতক্ষিরা, যশোর, রংপুর প্রভৃতি এলাকার খামারিরা মিল্কভিটা, প্রাণ, আকিজ প্রভৃতি কোম্পানির কাছে ২৯ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকায় প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করে থাকেন যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। বিক্রি করতে না পেরে অনেক সময় দুধ ফেলে দিতেও বাধ্য হয় খামারিরা।
হোসেন বলেন, বিশ্বের প্রধান দুগ্ধ উৎপাদনকারি দেশগুলো এখাতে বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকি দিচ্ছে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুধ পাউডার হিসেবে আমাদের মত দেশগুলোতে ডাম্পিং করছে। ডেনমার্ক ভিত্তিক সংস্থা অ্যাকশন এইড ‘মিল্কিং দি পুওর’ প্রতিবেদনে দেখিয়েছে কীভাবে ইউরোপের দেশগুলো ভর্তুকিতে উৎপাদিত দুধ অন্য দেশে ডাম্পিং করছে।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে স্বাবলম্বী হতে হলে গুড়াদুধ আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
বিডিএফএ মহাসচিব শাহ এমরান বলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাথাপিছু দৈনিক ২৮০ মিলিলিটার দুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সে হিসাবে বাৎসরিক চাহিদার পরিমান প্রায় ১৪৫০ কোটি লিটার। ২০১৭ সালে দেশে উৎপাদিত হয়েছে চাহিদার ৬২.৪ শতাংশ অর্থাৎ আমদানি নির্ভরতা ছিল মাত্র ৩৭.৬ শতাংশ, মাত্র ৭ বছর আগে এ নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৬০ ভাগ।
এমরান বলেন, বিগত ৫ বছরে গুড়া দুধের আমদানি ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এতে এক ধরনের কমিশন বাণিজ্য কাজ করছে। শুরুর দিকে গুড়ো দুধের ওপর আমদানি শুল্ক ছিল প্রায় ৫১ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এ হার ছিল ২৫ শতাংশ। কিন্তু এ বছর তা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় এফএমপি’র পুষ্টি গুণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটি আসলে দুধ থেকে প্রাণিজ ফ্যাট তুলে নিয়ে তাতে ভেজিটেবল ফ্যাট (পামওয়েল/কোকোনাট ওয়েল) মিশিয়ে তৈরি করা একটি পণ্য। সে অর্থে এটি ন্যাচারাল নয় বরং কৃত্রিম একটি প্রোডাক্ট।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় বিগত ৫ বছরে দেশে কয়েক লাখ শিক্ষিত বেকার যুবক ও প্রবাসী এখাতে বিনিয়োগ করেছেন। এ খাতটি প্রায় ৫০-৬০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, ২০১০-১১ সালে দুগ্ধ খামারের সংখ্যা ছিল ৭৯,৯৪২টি। ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ৩.২১ শতাংশ, প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে মোট কর্মসংস্থানের ২১ শতাংশ, মোট আমিষের ৮ শতাংশ আসে মাংস ও দুধ থেকে।
বক্তারা বলেন, সাধারণ মানুষের ক্ষুধা নিবারণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, সুস্বাস্থ্য ও মেধার বিকাশে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আগামীতে প্রাণিসম্পদখাত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন- জাতীয় দুগ্ধ ডেভেলপমেন্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও ব্র্যাকের ডেইরি অ্যান্ড ফুড বিভাগের পরিচালক মো. আনিসুর রহমান, বাংলাদেশ এসএমই করপোরেশন লি. এর পরিচালক- হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, আজাদ চৌধুরি; অক্সফ্যাম এর সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মুহতাসীম বিল্লাহ, লালতীর লাইস্টক লি. এর নির্বাহী পরিচালক কাজী এমদাদুল হক এবং কেয়ার-বাংলাদেশ এর মার্কেট ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট সাদরুজ্জামান নূর (তামাম)।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত দুগ্ধ খামারিরা সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন